ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে প্রয়োজনে আইন হোক

প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৫:১৩

আরিফুর রহমান

আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিবসটি একই সঙ্গে আমাদের জন্য শোকাতুর ও গর্বের।

ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা পাকিস্তানি শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তেজোদীপ্ত প্রতিবাদে জীবন দিয়ে গেছেন। বুকের রক্তে রঞ্জিত করেছেন রাজপথ। তাদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয় শাসকগোষ্ঠী।

এরই ধারাবাহিকতায় আমরা স্বাধীন হয়েছি লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে। ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব দেয়া হয় বাংলাদেশের পক্ষে। সেটি পাস হওয়ার পর ভাষাশহীদদের স্মরণে ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা বিশ্ব দিনটি পালন করছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।

এদিন সারা বিশ্বের মানুষ পালন করে একুশে ফেব্রুয়ারি। এই গর্বের একমাত্র দাবিদার বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা সশ্রদ্ধচিত্তে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ভাষাশহীদ রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ও অসংখ্য ভাষাসৈনিকদের। একই সঙ্গে স্মরণ করছি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভ’মিকা রেখে গেছেন, ভাষার দাবিতে জেল খেটেছেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো গৌরব-মুকুট আমাদের ললাটে শোভা বর্ধন করবে, এমন চিন্তা করে জীবন দেননি ভাষাশহীদরা। তারা মায়ের ভাষায় কথা বলতে আর তার যথাযথ মর্যাদার দাবিতে নেমেছিলেন রাজপথে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে বিজয়ের ২৩ বছর পর একাত্তরে আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হলাম, সেটাও প্রায় ৪৮ বছর আগে, এখনো ভাষার পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা আমরা দিতে পারিনি।

দেশের সরকারি দপ্তরে অনেক ক্ষেত্রেই এখন বাংলা ব্যবহার হয় বটে, কিন্তু উচ্চ আদালতে রায় লেখা হয় ইংরেজিতে। বাংলায় রায় লেখা নিয়ে চেষ্টা-উদ্যোগ যে নেওয়া হয়নি তা নয়। কিন্তু কাজ হয়নি তেমন। বেসরকারি খাতেও বেশির ভাগ দাপ্তরিক কাজ চলে ইংরেজিতে।

শহর-বন্দর কিংবা নগর যেখানেই যাওয়া যাক ইংরেজি ভাষার সাইনবোর্ড উপহাস করে আমাদের। রাজধানীতে সিটি করপোরেশন কদাচিত কোথাও এসব সাইনবোর্ড উচ্ছেদে নামলেও তা এক-দুই দিন দু-একটা জায়গায় ঘুরে পরে থেমে যায়।  

রাজধানীসহ সারা দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে এই আন্তর্জাতিক ভাষায় দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন আছে। কিন্তু কষ্ট হয়, যখন শুনি এসব স্কুলের কোথাও কোথাও বাংলা বিষয়টিই পড়ানো হয় না। বাংলা প্রবাদ-প্রবচন উপেক্ষিত হয় সেখানে। তাহলে মাতৃভাষার মর্যাদা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকল কোথায়? আমাদের এই ইংরেজি মাধ্যমের প্রজন্ম মাতৃভাষার মর্যাদা ধারণ করবে কীভাবে?

ইংরেজি মাধ্যমের বাইরে যে সাধারণ শিক্ষার প্রজন্ম, তাদের ব্যবহারিক জীবনের কথোপকথনেও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনা উদ্বেগজনকভাবে ক্ষীয়মাণ। ইংরেজির মিশেলে বিকৃত ‘বাংলিশ’ ভাষা ব্যবহার করছে আজকের প্রজন্ম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও  বেসরকারি রেডিও স্টেশনগুলোয় যে ভাষা ব্যবহৃত হয়, তা আমাদের ভাষাশহীদদের কেবল লজ্জাই দিচ্ছে।

আমরা প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটা করে প্রভাতফেরি করি, খালি পায়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি গেয়ে গেয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি; এরপর সারা বছর ভুলে থাকি একুশের চেতনার কথা। ভাষাশহীদ রফিক-শফিক, সালাম-জব্বার-বরকতরা কি এ জন্য জীবন দিয়ে গেছেন?

এখন আমাদের মাথার ওপর ভিনদেশি শাসক নেই, তাদের পুলিশের উদ্ধত সঙ্গীন নেই, অথচ আমরা ভাষাকে নানাভাবে বিকৃত করছি। পাকিস্তানি শাসকরা উর্দু হরফে বাংলা লিখতে প্রস্তাব দিয়েছিল, আমরা তা মেনে নিইনি, কিন্তু এখন নানা প্রাযুক্তিক মাধ্যমে রোমান তথা ইংরেজি হরফে বাংলায় তথ্য আদান-প্রদান করছি।

তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ভাষাবিকৃতির আশঙ্কা যেমন থাকে, তেমনি ভাষার বিশ্বব্যাপী প্রসারের বিপুল সম্ভাবনাও রয়েছে। সেটি আমরা কীভাবে কাজে লাগাতে পারি তা নীতিনির্ধারকদের ভাবতে অনুরোধ করছি। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে পারে। তাদের প্রচষ্টায় আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা বিশ্বের অন্যতম এক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হবে, এই  আশা করছি।

আমরা মনে করি, ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমাদের সরকারি আদেশ-নির্দেশই সব নয়, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য আমাদের প্রত্যেকের যার যার জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে। ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতা ও জাতীয় জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই বাংলার সঠিক ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনে আইন করে এর বিকৃতি রোধ করতে হবে।