মানুষ মরেছে রাস্তায়, রেস্তোরাঁয়, দোকান, বাসায়

প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৭:৫৭ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২১:২৯

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস

প্রতিদিনের মত বুধবার রাতেও ব্যস্ত ছিল পুরনো ঢাকার চুড়িহাট্টি চৌরাস্তা। চলছিল ব্যবসা। ভিড় ছিল খাবার হোটেল। লোকে লোকারণ্য ছিল চুড়িহাট্টা। সঙ্গে চিরচেনা যানজট ঠেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া। বুধবার রাত তখন সাড়ে দশটা। লোকের আনাগোনায় যখন এলাকাটি লোকারণ্য, তখনি ঘটল ঘটনাটি।

যানজটের মধ্যে চৌরাস্তায় চুড়িহাট্টা শাহী জামে মসজিদের সামনে একটি পিকাপভ্যান ও প্রাইভেট কার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সাথে সাথে প্রাইভেট কারের গ্যাস সিলিন্ডারটিতে বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে তা ছড়িয়ে পরে চারপাশে। যানজটে বসে থাকা মানুষগুলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুনের লেলিহান শিক্ষা তাদের গ্রাস করে।

আগুনের একটি ফুলকি গিয়ে পাশের খাবার হোটেলে পরলে, খাবার হোটেলে থাকা আরো কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। সেখানে যারা খেতে গিয়েছেন, তাদের কয়জন বেঁচে ফিরেছেন, সেটিও এক বড় প্রশ্ন।

এই বিস্ফোরণের পর  আগুনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। একদিকে সরু গলি, অন্যদিকে যানজট। সব মিলিয়ে ছুটোছুটি করে প্রাণ বাঁচানোর সুযোগও হয়ে ওঠেনি ঐসময় সড়কে যানজট আর ব্যবসার কাজে অপেক্ষমাণ মানুষগুলোর।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুন ছড়িয়ে পরে সড়কের সব দিকে। আর তখনি আগুনে দগ্ধ হয় পথচারীরা। এদের মধ্যে বাঁচতে পেরেছেন কমই।

পুরনো ঢাকার চক বাজারের ২৬, আজগর লেনের বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন বাবু বুধবার রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে আসেন প্রতিদিনের আড্ডাস্থলে। কিন্তু ঘটনার পর এখনো তার সন্ধান মেলেনি।

একই ঘটনা ঘটেছে তাসফিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক এনামুল হোসেনের ক্ষেত্রে। তিনি ও তার দোকানের কর্মচারী তুষার রিকশায় করে যাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণের সময় তুষার ও এনামুল দুইজন দুই দিকে ছুটতে শুরু করেন। সামান্য আহত অবস্থায় তুষার ফিরে আসলেও এখনো নিখোঁজ যানজটের বিকশায় থাকা এনামূল হোসেন। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেও তাকে খুঁজে পাননি তার পরিবারের সদস্যরা।

ঘটনার ১০ মিনিট আগে ছেলেকে বাসায় খাওয়া-দাওয়া করতে পাঠায় মুদি ব্যবসায়ী আলমগীর। ছেলে পারভেজ বাসার পৌঁছানোর আগেই ঘটে আগুন। আর তখন থেকেই নিখোঁজ ১৮ বছর বয়সী এই যুবক।

চকবাজারের আগুনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নেয়ামত উল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ঘটনার সময় ওই জায়গায় অনেক লোকের জমায়েত ছিল। আর এখানে জমায়েতের ঘটনা নতুন না। প্রতিদিনই এই পথ দিয়ে হাজার হাজার মানুষ চলাচল ও তাদের ব্যবসায়িক কাজে আসে।’

‘রাস্তায় ম্যালা লোক ছিল। যাম তো এই রাস্তায় সব সময়ই থাকে। সিলিন্ডারটা ফাটল, নগদ আগুন ধরইরা গেল। রাস্তায় যারা ছিল, তাগো ক্ষতি বেশি হইছে।’

‘পাশের বাসা-বাড়িতে যারা ছিল, তারা অনেকে লাফালাফি কইরা হাত-পা ভাঙলেও জান বাঁচছে।’

বশির আহমেদ নামের আরো একজন বলেন, ‘অনেকে বলছে ক্যামিকেলের গোডাউন থেকে আগুন ধরছে। একটু ভুল কথা। আমি তখন পাশের এটিএম বুথের সামনে ছিলাম। সিলিন্ডার থেকে আগুন লাগছে। সিলিন্ডার বার্স্ট হওয়ার পর সব দিকে আগুন ছিটে যায়। রাস্তায় যারা ছিল, তাদের ক্ষতি তখন বেশি হইছে।’

চুড়িহাট্টা শাহী জামে মসজিদের পূর্ব দিকে একটি চারতলা ভবন। হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন নামের ভবনটির নিচ তলায় ছিল খাবার হোটেল ও বেশ কয়েকটি দোকান। ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয় তলা ও আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল বডি স্প্রে, খেলনা, লাইট, রেজার, পাউডারের গুদাম। একই ধরনের গুদাম ছিল তৃতীয় তলায়। ভবন মালিক থাকতেন চতুর্থ তলায়। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তা চোখের পলকে ছড়িয়ে পরে প্রতিটি তালায়। বডি স্প্রে, পাউডারে প্রচুর পরিমাণে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন আরো তীব্র হয়ে ওঠে।

আগুন লাগার পর আগুন থেকে রক্ষা পেতে ওই ভবনের নিচ তলায় এক দোকানি প্রাণ রক্ষার জন্য দোকানের সাঁটার নামিয়ে ভেতরে আশ্রয় নিলেও প্রাণ রক্ষা হয়নি।

একই ঘটনা ঘটেছে ওয়াহেদ ম্যানশনের বিপরীতের ভবনে। সেখানেও প্রাণহানি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার পর অনেকেই ভবন থেকে লাফিয়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করেন। এদের কেউ কেউ কিছুটা আহত হয়ে প্রাণ রক্ষা করতে পারলেও, আবার অনেক নিচে নামতেই আগুনে প্রাণ হারিয়েছেন।