বাংলার সঠিক চর্চা নিয়ে ভাষা সৈনিক শহিদুল্লাহর আক্ষেপ

প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৯:১৭

তারিকুল ইসলাম, ময়মনসিংহ

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্লোগানে মুখরিত করেছিল এদেশের দামালরা। মায়ের মুখের ভাষার অধিকার আদায়ে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। এসেছিল সফলতা। তাদের অধিকাংশই আজ প্রয়াত। তবে হাতেগোনা যে কজন ভাষা সৈনিক বেঁচে আছেন তাও আবার বুক ভরা আক্ষেপ নিয়ে।

মাতৃভাষার দাবীতে ১৯৫২ সালের দুনিয়া কাঁপানো আন্দোলন, সংগ্রামের অর্জন বিশাল। অমর একুশ এখন জাতীয়তার গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারাবিশ্বে। কিন্তু যে মাতৃভাষা বাংলার জন্য ভাষা আন্দোলন  ৬৪ বছরেও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সেই বাংলা ভাষা চালু না হওয়া ও বিভিন্ন স্তরে বাংলা ভাষার বিকৃতি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে সর্বস্তরে পরিশিলিত বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি জানিয়েছেন ময়মনসিংহের এক ভাষা সৈনিক। সেই সাথে তিনি ভাষা শহীদদের জীবনী প্রচার ও সারাদেশের ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানোরও দাবি জানিয়েছেন।

এই মহান ভাষা সৈনিক হচ্ছেন ময়মনসিংহে মুক্তাগাছা উপজেলার সাবেক গণপরিষদ সদস্য খোন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ।

বয়সের ভারে তেমন চলাফেরা করতে পারেন না। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের কথা আসলেই স্মৃতি নিয়ে জেগে উঠেন হৃদয় থেকে।

শহিদুল্লাহর জন্ম ১৯৩৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুক্তাগাছার নন্দী বাড়ি এলাকায়। এই ভাষা সৈনিক একাধারে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তাগাছা পৌরসভার মেয়র এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদককের দায়িত্ব পালন করেন।

’৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে চলমান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ায় স্কুল থেকে রাজ টিকিটে বহিষ্কার, হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়ানোসহ নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। তিনি তখন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের কো-অপারেটিভ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এমন সময় ভাষা সংগ্রামে স্থানীয়ভাবে অগ্রে থেকে কাজ করেন।

তিনি বলেন, ভাষা সংগ্রাম, ভাষা শহীদ এবং ভাষা সংগ্রামীদের জীবনী সঠিকভাবে উঠিয়ে এনে পাঠ্যপুস্তকে সবিস্তারের লিপিবদ্ধ করে নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস জানানো দরকার। আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এ জন্য রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসা উচিত।

তিনি বলেন,  চার দিকে ভাষার বিকৃতি, বিদেশি ভাষার মিথ্যে ঠাট আর রাজনীতিতে হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ দেখে নিজের কাছেই লজ্জা লাগে, খুব দুঃখ পাই। অথচ এই ভাষার জন্য কত কষ্টই না করলাম। ছাত্রত্ব হারালাম, ফেরারি হলাম, জেল খাটলাম, জেলে থাকা অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরেও এলাম। যে ভাষার জন্য এত কিছু সে ভাষা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পেয়েছে এটা সত্যিই যে কত গর্বের, অহংকারের তা বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু বাঙালি হিসেবে আমাদের উচিত এখনই বাংলা ভাষার গৌরব ধরে রাখার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

টিভি নাটক ও এফএম রেডিওসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বাংলাভাষার বিকৃতি দেখে তিনি বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এসব বন্ধ করা উচিত। তিনি বলেন, সিয়েরালিয়নসহ পৃথিবীর অনেক দেশ আজ বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পাশাপশি এটাও আমাদের জন্য অনেক গর্বের পাওয়া। তিনি বলেন, প্রার্থিব কোন লাভ ক্ষতির বিচারে নয় বরং জাতির স্বার্থে বিবেকের তাড়না থেকেই সেদিন ছাত্রসমাজ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছিল। পরবর্তীতে কৃতজ্ঞ জাতিই সময়ে সময়ে ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের সম্মান জানাত। এ সম্মানটুকুই একজন ভাষা সংগ্রামীর তৃপ্তি। কিন্তু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ভাষার বিকৃতির কারণে কিংবা বিজাতীয় ভাষা সংস্কৃতির ছোবলে পড়ে দৈন্যদশায় নিপতিত হলে কষ্ট লাগে। তিনি জাতির স্বার্থেই সর্বস্তরে পরিশিলিত বাংলা ভাষা প্রচলন ও চর্চার দাবি জানান। সে জন্য সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন। পাশাপশি তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সারাদেশের ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানোর দাবিও জানান।

(ঢাকাটাইমস/২১ফেব্রুয়ারি/এলএ)