কৌশলে হেরেছে ঐক্যফ্রন্ট, কর্মসূচি চেয়ে কেন্দ্রকে চাপ
প্রকাশ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২০:১৩ | আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০৫
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের কৌশল বুঝতে না পারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। সরকার প্রধানের কথায় বিশ্বাস করাই ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের ভুল ছিল। তাছাড়া নির্বাচনের পর জোরালো প্রতিবাদ কর্মসূচি দিতে না পারাকেও দুষছেন পরাজিত প্রার্থীরা। এখন তারা বিএনপিনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিতে একদফা দাবিতে জোরালো কর্মসূচি চান।
৩০ ডিসেম্বর ‘ভোট ডাকাতির’ অভিযোগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গণশুনানিতে জোটের পরাজিত প্রার্থীরা তাদের ভোটের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে এসব কথা বলেছেন।
সারাদেশের কেন্দ্রগুলোতে কী ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তা জানাতেই শুক্রবার সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এই শুনানির আয়োজন করা হয়।
ধানের শীষের প্রার্থীদের অভিযোগ, ৩০ ডিসেম্বর কোনো ভোটই হয়নি, সেদিন ‘ভোট ডাকাতি হয়েছে’। বিএনপির জোট ঐক্যফ্রন্ট সাড়ে ১৩ শতাংশ ভোট আর আটটি আসন নিয়ে একেবারে তলানিতে অবস্থান করছে। ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে তারা এই নির্বাচনের ফলাফলও মেনে নেয়নি।
গণশুনানিতে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে গিয়ে প্রার্থীরা ‘নির্বাচনের নামে প্রহসনের’ প্রতিবাদে সরকারের বিরুদ্ধে এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি দেয়ার দাবি জানান। একইসঙ্গে ভোট কারচুপির অভিযোগে জেলায় জেলায় গণআদালত প্রতিষ্ঠার দাবি করেছেন তারা।
দিলারা চৌধুরী, এমাজউদ্দীন আহমেদ, আসিফ নজরুল, নুরুল আমিন বেপারি, মহসিন রশিদ ও আনিসুর রহমান খান গণশুনানিতে জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে মঞ্চে ছিলেন। তাদের সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন। আর উপস্থিত ছিলেন।বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ বিএনপির শীর্ষ নেতারা।
ভোটের দিনের কথা স্মরণ করে কুড়িগ্রাম-২ আসনের গণফোরাম ও ধানের শীষের প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) আমসা আমিন বলেন, ‘সেদিন কোনো নির্বাচনই হয়নি। একটি কেন্দ্রে ধানের শীষে ভোট পড়ায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে ব্যালট পেপার পুড়িয়ে ফেলে। সেদিন তারা ব্যালট নয় গণতন্ত্রকে পুড়িয়েছিল। সংবিধান ও জনগনের ভোটের অধিকারকে পদদলিত করেছে।’
ডাকাতি হয়েছে উল্লেখ করে লালমনিরহাট-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, ‘আমার এলাকায় সাতটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট কাস্ট হয়েছে বলে বলা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে অনেক মৃত মানুষও সেখানে ভোট দিয়েছে। এই হলো আমাদের নির্বাচনের অবস্থা। আমার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।’
যশোর-৩ আসনের প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ‘নির্বাচনের আগে আমার ওপর তিন দফায় হামলা হয়েছে। আমার এক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আর ভোটের দিন সকাল দশটার মধ্যে সব ব্যালট শেষ হয়ে যায়। এটা কিসের ভোট হয়েছে? প্রশাসনের সহযোগিতায় ভোট ডাকাতি হয়েছে।’
‘জেলায় জেলায় গণ আদালত বসিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ওই আদালতে জনগণ তার রায় দেবে। এক দফা কর্মসূচি দিয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে।’
সিরাজগঞ্জ-২ আসনের প্রার্থী রুমানা মাহমুদ তার কর্মী মেরি বেগমকে নিয়ে হাজির হন গণশুনানিতে। বলেন, ‘আমাদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। আমরা প্রচার প্রচারণা করতে পারিনি। আমার নেতাকর্মীদের মামলা দিয়ে জেলে রেখেছে।
রুমানা মাহমুদের কর্মী মেরি বেগম বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় আমাকে গুলি করা হয়েছে। তাতে আমার দুটি চোখই অন্ধ হয়ে গেছে। তাতেও আমার দুঃখ নাই। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হতো। কিন্তু সেটি নির্বাচন কমিশন করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের কাছে আমার ভোটের অধিকার চাই, নইলে আমার চোখ ফেরত চাই।’
বরিশাল-৬ আসনের আবুল হোসেন খান বলেন, ‘এটা নির্বাচন ছিল না। এটা ছিল রাষ্ট্রীয় ডাকাতি। প্রশাসনের বিভিন্ন বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে সরকার সুচারুভাবে রাষ্ট্রীয় ডাকাতি করেছে। এর বিরুদ্ধে গণআদালত প্রতিষ্ঠা করে জনগণের রায় নিয়ে গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’
কুমিল্লা-১০ আসনের মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমি কারাগারে ছিলাম। আমার মনে হয়েছে কারাগার বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। কারণ কারাগারে মানুষ কঠোর নিরাপত্তায় থাকে কিন্তু বাহিরে কোনো নিরাপত্তা নেই।’
‘নির্বাচনে যাই হোক না কেন দিনশেষে আমরা পরাজিত হয়েছি এটাই সত্য। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর দেশের মানুষ আমাদের সঙ্গে ছিলো। নির্বাচন হয়নি তারপরে তারা ভেবেছিল ৩১ তারিখ একটা আন্দোলনের ডাক আসবে কিন্তু সেটা আপনারা দেননি। জানি না কি জন্য আপনারা এখনো আন্দোলনে যাচ্ছেন না। তৃণমূল একটা মহাসমাবেশ চেয়েছিল আপনারা কেন দিতে পারলেন না এটার জবাবদিহিতা চাই।’
কুষ্টিয়া -২ আসনের আহসান হাবিব লিংকন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে সিনিয়র এক কর্মকতা আমার ঘনিষ্ঠ তিনি আমাকে ফোন করে বলেছেন, যে আপনার নির্যাতনের শিকার হয়ে যে নির্বাচন কমিশনের দোষ দেন তাদের দোষ দিয়ে কি লাভ। নির্বাচন কমিশনের অধীনে তো পুলিশ না, এবার পুলিশের অধীনে নির্বাচন কমিশন।’
তিনি শুনানিতে ২০দলের শরিক দলে নেতা অলি আহমেদ ও সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহীম উপস্থিত না থাকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
নোয়াখালি-৫ আসনের জয়নাল আবেদিন ফারুক বলেন, ‘আজকে আ.লীগের কৌশলের কাছে ঐক্যফ্রন্টের পরাজয় হয়েছে। এখন এটা থেকে রক্ষা পেতে হলে দ্রুত একটা আন্দোলনের ডাক দেন আর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবেন না। আপনারা শুধু একটা কর্মসূচি দেন তারপরে বেগম জিয়াকে মুক্ত করার দায়িত্ব আমাদের।’
কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের প্রার্থী ফজলুর রহমান বলেন, ‘গত সাত বছরে আমি এলাকায় যেতে পারি না। ওখানকার এসপি আমাকে যেতে নিষেধ করে। মাত্র ঈদের সময় যাতে পারি। নির্বাচনের আগে আমার এলাকায় প্রথম নির্বাচনী কার্যালয়ে তালা দেয়া হয়। আমার এলাকার নেতাকর্মীরা হাওরে রাত কাটিয়েছে।২৮ তারিখ থেকে আমাকে অবরুদ্ধ করে হয়েছিল।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘দেশটা কি পাকিস্তানের চেয়ে ভালো রয়েছে?’ সবাই তখন চিৎকার বলেন, ‘না’।
মাগুরার নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, ‘কেন সংসদ বহাল রেখে, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে গেলাম। এটা আমাদের ঠিক হয়নি। ভোট কারচুপির পরও আমরা কেন এখনো কর্মসূচি দেয়নি।’
নরসিংদী-৪ সাখাওয়াত হোসেন বকুল বলেন, ‘রিকশাওয়ালা বলে এর থেকে পাকিস্তানিরা ভালো ছিলো। ভোট দেয়া যেত। এখন তো ভোটও হয় না। ভোট দিতেও পারি না। এটা কোনো নির্বাচন হয়নি।
‘খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে আমরা নির্বাচনে গেলাম। কি হয়েছে ফলাফল সেটাও আমরা দেখেছি। এখন আমরা আমরা বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কর্মসূচি চাই।’ কেন এতদিনে কেন কর্মসূচি দেয়া হয়নি সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি।
জামালপুর- ৪ আসনের ওয়ারেস আলী মামুন বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার দিনই আমাদের পরাজয় হয়েছে। তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার যখন সাজা দিয়েছে সেদিনই আমাদের পরাজয় হয়েছে। শর্তহীনভাবে নির্বাচনে যাওয়ার দিনই আমাদের পরাজয় হয়েছে।’ তিনি অবিলম্বে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি দেয়ার দাবি জানান।
শেরপুর-৩ আসনের মাহমুদ হক রুবেল বলেন, ‘৩০ ডিসেম্বর সারা দেশে একই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। আর সেটার নায়ক ছিলেন মাত্র একজন। নির্বাচন ২৯ তারিখেই সম্পন্ন করা হয়েছে। নির্বাচনে পরে দেশের সকল প্রার্থীরা ভেবেছিল কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড থেকে আন্দোলনের কোন নির্দেশনা আসবে। কিন্তু সেটা তারা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনের পরের দিন আমরা শুনেছিলাম ঢাকায় একটা সমাবেশ হবে কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর আলোর মুখ দেখেনি। কেন আমরা এই প্রহসনের নির্বাচনের পর একটা প্রতিবাদ সভা পর্যন্ত করতে পারলাম না?’
চট্টগ্রামের শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের অধীনে দেশে ভোট ডাকাতির যে মহাৎসব চললো। কিন্তু দলের পক্ষ থেকে সেটার কোনো কার্যকরী প্রতিবাদ করা হলো না। সিনিয়র সবাইকে নিশ্চুপ থাকতে দেখা গেল। আপনারা নিশ্চুপ থাকলে জবাবদিহি করতে হয় না কিন্তু আমাদের ঠিকই তৃণমূলের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।
‘নির্বাচন পরবর্তী আমরা আশা করেছিলাম অন্তত নির্বাচন কমিশনের সামনে একটা প্রতিবাদ সভা করা হবে কিন্তু সেটাও করা হলো না।’
ফরিদপুর-২ আসনের শামা ওবায়েদ ইসলাম রিংকু বলেন, ‘সরকারের এই প্রহসনের নির্বাচন দেশের মানুষ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে। যদি তারা ভোট ডাকাতি না করতো তাহলে তাদের মাঠে খুজে পাওয়া যেতো না। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো শেখ হাসিনাকে তার নির্বাচনী এলাকা টুঙ্গিপাড়ায়ও ভোট ডাকাতি করতে হয়েছে। এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে রাজপথে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। আমরা দলের হাইকমান্ডকে বলবো আপনারা দ্রুত একটা আন্দোলনের কর্মসূচি দেন বেগম জিয়াকে মুক্ত করুন।’
সাতক্ষীরা-২ আসনের হাবিবুর রহমান হাবিব নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘কর্মসূচি দেন। তৃণমূল কর্মসূচি চাইতে চাইতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আপনারা কেন সেটা দিতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন।’
পিরোজপুর-৩ আসনের রুহুল আমিন দুলাল বলেন, ‘নেতাদের বলবো আর ভালো লাগে না কিন্তু। সঠিক কর্মসূচি চাই। খালেদা জিয়ার মুক্তি না হলে আমাদের মুক্তি হবে না। খালেদা জিয়াকে সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অন্যত্র স্থানান্তরের দাবি জানান।’
নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সুন্দরভাবে ভেবেচিন্তে, মানুষকে সম্পৃক্ত করা যায় এমন কর্মসূচি দেন। একটু নাড়াচাড়া দেন। এই শুনানি বাইরে হলে ভালো হত। এত ভয় পেলে চলবে না। ভয় পেলে এই বক্তব্য আর টিভিতে কথা বলেই শেষ।’
ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেন সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ‘নির্বাচনের নামে প্রসহন হয়েছে। কে দিতে বলেছে এমন নির্বাচন। আজকে সবার কথায় বোঝা গেছে একটা তথাকথিত নির্বাচন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ যখন এমনটা করে তখন দুঃখ পাই।’
দেশে একদলীয় নয়, এক ব্যক্তির শাসন চলছে দাবি করে গণফোরাম সভাপতি বলেন, ‘যা ইচ্ছা তাই হচ্ছে। আর কিছু প্রশাসনের লোক এর সঙ্গে জড়িত। আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত। একদিন চাকরি শেষ হবে, একদিন মরে যাবেন তখন আপনার উত্তরসূরীরা আপনাদের এক মিনিটের জন্যও স্মরণ করবে না।’
কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি তার ন্যায্য দাবি বলেও মন্তব্য করেন ডা. কামাল। শুনানিতে মোট ৪১জন প্রার্থী তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
(ঢাকাটাইমস/২২ফেব্রুয়ারি/এসআর/বিইউ/ডিএম)