উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই আমলামুক্ত কমিশন
প্রকাশ | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৪০
উচ্চ শিক্ষা কমিশন গঠনের জন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বাংলাদেশ অধিককাল ধরে এদেশের উচ্চ শিক্ষার মান বৃদ্ধিকল্পে শেখ হাসিনার চিন্তা-চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক আদর্শকে সমন্বয় সাধন করে, শিক্ষার জন্যে আদর্শ ও গবেষণানির্ভর শিক্ষকমণ্ডলীর বিকাশ সাধনকল্পে নানামুখী প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষকদের কর্মসম্পাদন আমলাতান্ত্রিক জটিলতামুক্তভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে শিক্ষকদের মান-সম্মানকে একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার নং ১০ (১৯৭৩) এর মাধ্যমে স্থাপিত হয়।
প্রতিষ্ঠানটির মৌল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বায়ত্তশাসন নিরঙ্কুশ করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা অনুসারে অর্থ সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া। প্রতিষ্ঠাকালে ছয়টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল যার মধ্যে চারটি সাধারণ বিষয়ে আর দুটির মধ্যে একটি হচ্ছে কৃষিভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যটি প্রকৌশল বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হচ্ছেন প্রফেসর আব্দুল মান্নান। যুগের চহিদা অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষা কমিশনে রূপান্তর প্রয়োজন যা কিনা আমলাতন্ত্রমুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে বঙ্গবন্ধু কখনো চাননি আমলারা এসে শিক্ষকদের মান-মর্যাদা ধূলিস্যাৎ করুক, পরিচ্ছন্ন পরিবেশকে লাল (এখন অবশ্য সাদা) ফিতার দৌরাত্মে সব কাজকে আটকে দেয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয় যে উদ্দেশ্যে সমগ্র বিশ্বে কাজ করছে অর্থাৎ জ্ঞানের সমুদ্র হোক - সেটি যেন বজায় থাকে সে জন্যে জাতির পিতার গভীর আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যেমন আজীবন শিক্ষকদের সম্মান করতেন, তেমনি তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও শিক্ষকদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে থাকেন। কয়েকদিন আগে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে ড. আনিসুজ্জামানের চাদর পরম মমতাময়ী কন্যার মতো জননেত্রী শেখ হাসিনার চাদর ঠিক করে দিতে দেখে মন নেত্রীর ওপর শ্রদ্ধায় ভরে গেল। শিক্ষকের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করতে বারবার একটি মাফিয়া নেক্সাস কাজ করছে। তবে শিক্ষকেরা যেন তাদের মান মর্যাদা ঠিক রাখেন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শিক্ষার আলো চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে সচেষ্ট রয়েছেন। ফলে এখন ৪৯টি সরকারি এবং ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও মূল অধ্যাদেশ চেয়ারম্যান এবং পূর্ণকালীন দুজন সদস্য ছিলেন- এখন সেখানে পাঁচজন পূর্ণকালীন সদস্যের কথা Amendment করা হয়েছে। লোকবল সংকট সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গত তিন বছরের অধিককাল ধরে Propeople কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। এটি অবশ্যই বর্তমান চেয়ারম্যান মহোদয়ের মুক্ত চিন্তা এবং জননেত্রীর আদর্শকে বাস্বায়নে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করার সুফল। তবে ধারাবাহিকভাবে এখন উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে আমলাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অধিক হারে বাজেট বরাদ্দ দেয়া-অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং গুণগতমান বৃদ্ধিকল্পে নানামুখী ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণে প্রকল্পসমূহ গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। অনেকগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলোতে সনদ বাণিজ্য ছিল বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে সেগুলোকে সঠিক পন্থায় পরিচালনার ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছেন। উচ্চ শিক্ষা মান উন্নয়ন প্রকল্প (হেকেপ) প্রকল্পের আওতায় দুই হাজার কোটি টাকার কার্যক্রম যার অর্থায়নে ছিল বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকার তা সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেছে।
বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনা রিপোর্ট অনুসারে দেখা যায় যে, ৯৯.২০% এ প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে যা এদেশের অন্য কোনো প্রকল্প এ যাবৎ অর্জন করতে পারেনি। এ প্রকল্পের ফলস্বরূপ ৬৯টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করে আগামী পাঁচ বছরে তা বাস্তবায়নের পদ্ধতিগত এবং লাগসই ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা। IQAC -এর আওতায় কার্যক্রম শুরু করেছে। এদিকে হেকেপের অন্যতম কার্যক্রমের আওতায় শিক্ষার গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্যে ১৯টি শিল্প চাহিদামুখী উদ্ভাবনী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে প্রাপ্ত ফলাফলে নয়টির মতো আন্তর্জাতিক প্যাটেন্ট পাওয়ার জন্য ইতিমধ্যে আবেদন করেছে।
বস্তুত শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষমতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন নিজেদের দক্ষতাকে সম্প্রসারিত করতে পেরেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যার মধ্যে চারটি সরকারি, চারটি বেসরকারি ও একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ITN , গাজীপুরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সহায়তা প্রদান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জার্মাণ সরকার GTZ -এর আওতায় ১৫০ মিলিয়ন ইউরো অনুদান দিচ্ছে। উপরন্তু ৩০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের HEAT নামক একটি প্রকল্প আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শিক্ষার মান উন্নয়নে রিজিওনাল কো-অপারেশনের আওতায় নানামুখী পদক্ষেপ বিশেষত উন্নত শিক্ষা এবং নারীদের শিক্ষার মান বৃদ্ধিকল্পে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। তবে হিট প্রকল্প বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। যাতে করে দশ বছর মেয়াদী শিক্ষা ক্ষেত্রে স্ট্যাটেজিক প্ল্যান তৈরি করে বাস্তবায়ন করা যায়। এ ক্ষেত্রে ভারতের এমটিসি প্রোগ্রামের প্রফেসর ভোলানাথ দত্তকে কাজে লাগানো যায়।
এদিকে তুরস্কের সরকার টেক্সটাইল ক্ষেত্রে ২০টি পিএইচডি ডিগ্রির স্কলারশিপ দিচ্ছে। অস্ট্রিয়া-সুইজারল্যান্ড উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার কোয়েকার মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। দেশে বিকাশমান উচ্চ শিক্ষা এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে সচেষ্ট রয়েছে। বর্তমান সরকার প্রধান যেখানে আগামী পাঁচ বছরে ১.২৮ কোটি লোকের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছে সেক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তার দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারে। ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিক্স ইতিমধ্যে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট এবং মাস্টার্স ইন ইকোনোমিক্স (উদোক্তা অর্থনীতি) চালু করেছে। এ প্রতিষ্ঠানে ইউজিসির প্রকল্পের আওতায় ইকোনোমিক ইনকিউবেটর স্থাপন করার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সৃজনশীল ও কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্রে অর্থায়ন করে উদ্যোক্তা সৃষ্টির পদক্ষেপত নিতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরির বিকল্প নেই। এ জন্যে উদ্যোক্তা আরো প্রয়োজন।
এদিকে ইউজিসি গবেষণার মান বৃদ্ধিকল্পে ২০০৯ সালে যেখানে ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল তা বাড়িয়ে ২০১৮ সালে ৩.৮০ কোটি টাকায় উন্নীত করেছে। তবে দেশ-বিদেশের আলোকে অধিক অর্থায়ন গবেষণা ক্ষেত্রে দরকার। জাতি হিসাবে আমাদের বৈশ্বিক পটভূমিতে মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্যে গবেষণা ক্ষেত্রে আরো জোর দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন লোকবল পদায়ন করে দেশে প্রকাশিত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জার্নালগুলোর ব্যাংকিং করতে পারে। আমলামুক্ত পরিবেশে বৈশ্বিক পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে।
এদিকে সরকার প্রধান গত তিন বছর ধরে ‘বাংলাদেশ উচ্চ শিক্ষা কমিশন আইন’ তৈরির নির্দেশনা দিয়ে এসেছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে উচ্চ শিক্ষা কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। তবে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে সাচিবিক কমিটি সকল দেশের নিয়ম তোয়াক্কা না করে শিক্ষকদের ওপর আমলাদের ছড়ি ঘোরানোর জন্যে সুপারিশ করেছেন। সচিব কমিটির এই সুপারিশ বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রীর নির্দেশনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ফলে আমলাদের হাত থেকে উচ্চ শিক্ষা বাচাতে হবে। অনেক শিক্ষাবিদ মনে করেন এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, এ ধরনের সচিব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে চরম অসন্তুষ দেখা দেবে।
এ ক্ষেত্রে সরকার প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনুরোধ করব যে, উচ্চ শিক্ষা যেন আমলাদের লাল ফিতার দৌরাত্মমুক্ত হয়। কেননা একজন প্রকৃত শিক্ষকই পারেন দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিতভাবে কাজ করতে। উচ্চ শিক্ষা কমিশন যেন আমলামুক্ত থাকে সেজন্যে বিশেষ অনুরোধ থাকল।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ; ই-মেইল: [email protected]