অসময়ে চলে গেলেন শাহ আলমগীর ভাই

আলম রায়হান
| আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:২৬ | প্রকাশিত : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:২৭

বড় অসময় চলে গেলেন আলমগীর ভাই, শাহ আলমগীর। তিনি ছিলেন বৃক্ষ সাংবাদিক। নানান ক্ষেত্রের মতো সাংবাদিকতা পেশায় আগাছার আধিক্য সীমা ছাড়িয়েছে অনেক আগে। আর শুধু আগাছা নয়, বিষবৃক্ষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। শুনতে অশ্বস্তিকর হলেও এটি বাস্তবতা। এ অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও আলমগীর ভাই বৃক্ষ হিসেবে নীরবে অবদান রেখেছেন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে। কিন্তু কেন তার এ অসময়ে চলে যাওয়া! উত্তর কঠিন; মেনে নেয়া আরও কঠিন! আমার ধারণা, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) ইতিহাসে শাহ আলমগীর উজ্জ্বলতম মহাপরিচালক হিসেবে বিবেচিত হবেন ভবিষ্যতে অনেক দিন, অতীতের বিবেচনায়ও। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহ আলমগীর ২০১৩ সালের ৭ জুলাই পিআইবি’র মহাপরিচালকের গুরুদায়িত্ব পান। ১৯৭৬ সালে যাত্রালগ্নে পিআইবি’র প্রথম মহাপরিচালক ছিলেন আবদুস সালাম। এরপর এ. তোয়াব খান, এ বি এম মুসাসহ বিশিষ্ট সাংবাদিকরা পিআইবি’র মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমলারাও ছিলেন এ পদে। শাহ আলমগীরের আগে পিআইবি’র মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন ৩২ জন। সরকার ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পিআইবি মহাপরিচালক হিসেবে মো. শাহ আলমগীরের মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধি করে। ফলে নিদেনপক্ষে ২০১৯ সালের জুলাই মাসের ০৭ তারিখ পর্যন্ত পিআইবি’র মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার কথা ছিল আলমগীর ভাইয়ের। কিন্তু আল্লাহর ডাকে সারা দিয়ে পরপারে চলে যেতে হয় তাকে।

শাহ আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের মেয়াদ মাত্র কয়েক মাসের। শুরুতেই আনন্দিত হয়েছিলাম, একজন নিখাদ ভালো মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার কারণে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এ সম্পর্ক না হলেই আমার জন্য ভালো হতো। কারণ, পরিচিতজনের চেয়ে ঘনিষ্ঠজনদের চলে যাওয়ার কষ্টের তীব্রতা অনেক বেশি। অনেকদিন পর কারও চলে যাওয়ায় অশ্রু সম্ভরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। তিনি আমার পেশাগত বৈরী পরিস্থিতির বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল ছিলেন। আসলে এইটি ছিলো তার ইনবিল্ট (সহজাত) প্রবণতা। বিষয়টি নিয়ে একদিন তার সঙ্গে কথাও হয়েছে। তিনি বলেছেন, সাংবাদিকরা যে বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার চেষ্টা করে তা আমার নিজের জীবনেও তো দেখেছি। এ সময় তার ছাত্রজীবনের বৈরিতার কথাও বলেছেন। একদিন তিনি বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর প্রায় এক বছর তারা দুই বন্ধুকে রাতের বেলা দোকানে ঘুমাতে হয়েছে। গভীর রাতে দোকান বন্ধ হবার পর ঘুমাতেন, উঠতেন সকালে দোকান খোলার সময় বিবেচনায় রেখে। হয়তো ছাত্রজীবনে নিজের এই বৈরী দশা মনে রেখেই তার কাছে কোনো ছাত্র গেলে সাধারণ সাধ্যের বাইরেও সহায়তা করতেন। এ বিষয়টি শুনছি এবং নিজেও দেখেছি। আর পিআইবি’র এখতিয়ারে সাংবাদিকের জন্য কতটা করেছেন তা কারোই অজানা নয়, হয়তো সকলেরই জানা।

বৈরী পরিবেশে পড়া সাংবাদিকদের প্রতি কেবল প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নয়, ব্যক্তিগত উদ্যোগও ছিল শাহ আলমগীরের। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে এক মৃত সাংবাদিকের পরিবারের ব্যাংক লোনের বোঝা বিরাট অংকে হ্রাস পেয়েছে। তার বিশেষ উদ্যোগে ব্যাংক লোনের বিশাল বোঝা থেকে মুক্ত হয়েছে পিআইবিও। মানবিকতা ও দক্ষতাসহ নানান মাপকাঠিতে শাহ আলমগীরের মতো খুব বেশি মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই।

পেশাগত জীবনে শাহ আলমগীর পৌঁছেছিলেন সর্বোচ্চ অবস্থানে। পেশাগত নেতাও ছিলেন। তার এ অধিষ্ঠান হয়েছে ধাপেধাপে, ধীরলয়ে। তাকে কেউ তাড়াহুড়া বা হাহুতাশ করতে দেখেনি। এদিকে আকাশ ছোঁয়ার অবস্থানে পৌঁছেও তিনি বদলে যাননি। অগ্রজদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন, বন্ধুদের সমাদর করেছেন, অনুজদের করেছেন স্নেহ। আর অনুজরাই যেনো ছিলো তার প্রধান লক্ষ্য। মমতা ও সহায়তার ছায়াতলে আশ্রয় দিয়েছেন অনুজদের। তিনি আসলে অন্যের আশ্রয়ের সুবিধার জন্য নিজেকে প্রসারিত করে রাখতেন; উদার বৃক্ষ যেমন প্রসারিত করে ডালপালা। অন্যকে আশ্রয় দেবার কারণে কখনো আবার বৃক্ষের ক্ষতিও হয়। মূল কাঠামোতে কোঠর বানিয়ে বাসা বাঁধে পাখি; ডানপালা ভাঙে বাদর-উল্লুকেরা। তবু বৃক্ষ কিছু বলে না! তেমনই আলমগীর ভাইকে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে শুনিনি।

দুস্থ সাংবাদিকরা ছিলেন আলমগীর ভাইকে কাছে বিশেষ গুরুত্বের, আলাদা বিবেচনার। হয়তো এ কারণেই তিনি আমার প্রতি মনোযোগী হয়েছিলেন। এমনকি সরকারি সহায়তা গ্রহণ করার জন্যও তিনি আমাকে বারবার বলেছেন। এক পর্যায়ে তার বলাটা প্রস্তাব ও অনুরোধের সীমা ছাপিয়ে পীড়াপীড়র পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে তিনি বুঝাবার চেষ্টা করেছেন, বৈরী পরিবেশে থাকা সংবাদিক হিসেবে এটি আমার নৈতিক ও আইনগত প্রাপ্য। তিনি এমনও বলেছেন, বিষয়টি তিনি ছাড়া আর কেউ জানবে না। কিন্তু এক রকম অর্থহীন অহমবোধের কারণে সরকারি সহায়তা গ্রহণে তার অভূতপূর্ব আন্তরিকতা এড়িয়ে গেছি। তবে এ ইস্যুতে তার কাছ থেকে প্রাপ্ত যে মমতা ধারণ করে রেখেছি তা পরিমাপ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।

পিআইবিব’র জন্ম ১৯৭৪ সালে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু’র নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকারের এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ১৯৭৪ সালের ২৪শে মে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয়। তখন ভাবা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির নাম হবে ন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের ১৮ আগস্ট একটি রেজুলেশনের মাধ্যমে পিআইবি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি)-এর কাজ মূলত সাংবাদিকতা, গণমাধ্যম ও উন্নয়ন যোগাযোগ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রকাশনা নিয়ে।

পিআইবি’র প্রধান কাজগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে (ক) কর্মরত সাংবাদিক এবং সরকার অথবা যেকোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে কর্মরত সংবাদ সংশ্লিষ্ট কর্মীদের প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করা (খ) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমধর্মী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাংবাদিকতা সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ এবং এ সম্পর্কিত উপাত্ত ও তথ্য প্রকাশ করা (গ) যেকোনো সংবাদপত্র বা বার্তা সংস্থায় উপদেশক ও পরামর্শক সেবা প্রদান করা (ঘ) সংবাদপত্র সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে সরকার মতামত চাইলে সেই বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ প্রদান করা (চ) বাংলাদেশে সাংবাদিকতার মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় অন্যান্য কার্যক্রম ও উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং (ছ) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা (এক শিক্ষাবর্ষ মেয়াদি) পরিচালনা করা।

বর্ণিত এ কর্মধারার বাইরেও দেশের সাংবাদিকতা নিয়ে অনেক কাজ করেছেন শাহ আলমগীর। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ‘অগ্রজের সঙ্গে একদিন’ শিরোনামে আইকন সাংবাদিকের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। এ স্মৃতিচারণ বই আকারেও প্রকাশ করা হয়েছে। এ ধরনের বই সম্ভবত তিনটি এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো পড়ে সাংবাদিকতার নানান দিক অধিকতর গভীরভাবে জানা যাবে। তিনটিই আমি পড়েছি। এর একটি পড়ে জেনেছি, আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাংবাদিক ও লেখক হয়ে ওঠার সূচনা হয়েছিলো বরিশাল থেকে প্রকাশিত দুটি পত্রিকার মাধ্যমে, ১৯৪৬ সালে। তখন তার বয়স ১২ বছর। তখন বরিশাল থেকে ‘বরিশাল হিতৈষী’ ও নকিব নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশত হতো; একটি দৈনিক এবং অপরটি সাপ্তাহিক। এখন বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিকের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়েছে বলে শুনেছি। বরিশাল থেকে প্রকাশিত বেশিভাগ পত্রিকার মান নিয়ে সাবেক জেলা প্রশাক মো. হাবিবুর রহমান আমার সঙ্গে আলাপকালে একবার বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি প্রচন্ড ক্ষেভে বলেছিলেন, মুরগি বিক্রেতাও পত্রিকার মালিক হয়েছে! কেবল প্রশাসন নয়, অনেক পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ও মান নিয়ে জনমনেও বেশ বিরক্তি রয়েছে।

অথচ বরিশাল থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় লিখে আবদুর গাফফার চৌধুরীর মতো কলজয়ী সংবাদিক ও লেখক তৈরি হয়েছে। এমনকি বরিশালের নকিব পত্রিকায় কাজী নজরুলও কবিতা লিখেছেন। কিন্তু এখন বরিশাল থেকে প্রকাশিত বেশিরভাগ পত্রিকায় কারা লেখেন, কী ছাপা হয়! এমনকি বরিশাল থেকে প্রকাশিত পত্রিকার কারণে অনেক সুষ্ঠু সাংবাদিক তৈরি হয়েছে। যারা এখন জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখছেন। কিন্তু বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে বরিশাল থেকে প্রকাশিত অনেক পত্রিকার সাংবাদিকতার মান নিয়ে অনেকেরই বেশ উদ্বেগ অছে।

এ ধরণের উদ্বেগ ছুঁয়েছিল পিআইবি মাহপরিচালক শাহ আলমগীরকেও। বরিশাল থেকে প্রকাশিত পত্রিকাসহ সারাদেশের পত্রিকার মান উন্নয়নে বিশেষ কিছু করার সক্রিয় ধারায় ছিলেন তিনি। এ নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলাপও করেছেন। তিনি একটি কর্মধারার ছকও প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু বিধি বাম! এখন কে বা কারা ভাববেন আলমগীর ভাইয়ের মতো? অভিজ্ঞতার আলোকে বাধ্য হয়েই আমাকে বলতেই হচ্ছে, মহান আল্লাহ জানেন!

আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :