আবদুল মান্নান চৌধুরীর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কিছু ঘটনা ও রটনা’

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী
 | প্রকাশিত : ০৩ মার্চ ২০১৯, ১৬:০৬

বইটি খুলে একটা হোঁচট খেলাম। ফ্লেপে বঙ্গবন্ধুর ছবি রয়েছে, লেখক পরিচিতি না থাকলেও শিরোনামহীন লেখকের একটা ছবি দেখলাম। থমকে দাঁড়ালাম। একি ভ্রান্তিবিলাস না অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। লেখক সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী এমন অভিমান করতেই পারেন। তিনি অত্যোজ্জল শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী। পড়াশুনা করেছেন কুমিল্লা জিলা স্কুলে, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যানচেষ্টার ও লন্ডনে।

তার বিদ্যার বহর, পেশাগত, প্রকাশনা উৎকর্ষতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা শুনে তিনি বিবেচিত হতে পারতেন, উপাচার্য হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোনার সাথে সোহাগের মিশ্রণ ঘটেছে। অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি তিনি সেই ১৯৫৯ সাল থেকে ছাত্র রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৬১ বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফ এর সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৩ সালের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েও এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রথম হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগ রাজনীতির মাঝে নিমজ্জিত থেকে ৬ দফা, ১১ দফা আন্দোলন ও বিএলএফ এর কার্যাবলীর সাথে সার্বক্ষণিক সম্পৃক্ত থেকেও অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায় এমন কৃতিত্বপূর্ণ ফল করেন যাতে পাকিস্তান আমলেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি ম্যানচেস্টার থেকে এমবিএ ও লন্ডন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু নিয়ে তাঁর শ্রদ্ধার আসন হৃদয়ের গহীনে আবৃত। আর তাই তো একের পর এক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি গবেষণা করে চলেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এ গ্রন্থটি রচিত হয়েছে।

শিক্ষাবস্থায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পক্ষে স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানান ও হবু যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন। ২৫ মার্চ গণহত্যার রাতে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। তারপর সীমান্ত অতিক্রম করে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের হাতিয়ার হিসাবে ‘বাংলাদেশ’পত্রিকার সম্পাদনা, প্রকাশনা ও কলাম লেখকের দায়িত্ব নেন। তারপর বিএলএফকে মুজিব বাহিনীতে রূপান্তরের পদক্ষেপে সযুক্ত হোন। নতুন করে দেরাদুনে গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুজিব বাহিনীর যুদ্ধ পরিচালনায় ব্যাপৃত থাকেন।

যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি প্রথমে পূর্বাঞ্চলে মুজিব বাহিনীর কোষাধ্যক্ষ, তারপর আঞ্চলিক প্রধানে সহকারী, দ্বিতীয় অবস্থান গ্রহণকারী ও সর্বশেষ মাস দুয়েকের জন্য আঞ্চলিক প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। মোট ২০টি প্রবন্ধ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রফেসর চৌধুরী আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে রচনা করেছেন। তার রচিত এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা অর্পণ করেছেন লেখক।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন করেন উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করেন ও বিদেশে চাকুরি ইস্তফা দিয়ে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। তার উদ্যোগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পক্টর ও সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট হিসেবে তিনি ছাত্র রাজনীতির স্বচ্ছতা আনয়ন ও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের পূনর্বাসনে ব্যাপক সহায়তা করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বস্তি উচ্ছেদ করে সে জায়গায় জিয়া হল ও বঙ্গবন্ধু হলের প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণে অদ্বিতীয় ভূমিকা রাখেন। ক্যাম্পাস থেকে সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন ও সন্ত্রাসীদের সাময়িক বা দীর্ঘ মেয়াদে উচ্ছেদে তিনি ছিলেন দৃঢ়চিত্ত ও অকুতোভয়। আলোচ্য গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত বিশিষ্ট পরমানু বিজ্ঞানী ড. এম. এ ওয়াজেদ মিয়াকে। যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুসারী। এটি একটি ভাল কাজ হয়েছে।

১৯৯২ সালে ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে যে সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন তার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। শত হুমকি, ভয় ভীতি ও প্রলোভনের মধ্যেও তিনি ঘাতক বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থেকে গণ-আদালত সংগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

তিনি গ্রন্থে লিখেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ পর্বে খন্দকার মোস্তাক ও কতিপয় কুচক্রী পাকিস্তানের সঙ্গে কোন বিশেষ ধরনের সংযুক্তি বা কনফেডারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলছিল। আসলে খন্দকার মোস্তাক, জিয়া, তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সাথে আরেকটি কুচক্রী হচ্ছেন মাহবুব আলম চাষী। আমলারা মাহবুব আলম চাষীর নাম আজ বেশী উচ্চারিত হয় না। আর সেই সব বাম যারা বঙ্গবন্ধু হত্যায় খুশী হয়েছিল। গণআদালতের সংগঠকদের মধ্যে সম্ভবতঃ তিনি রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিধা মাথায় নিয়ে বেঁচে আছেন।

এখন তিনি যুদ্ধাপরাধ বিরোধী মানবাধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে আছেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের ক্রমান্বয়ে নির্মূলের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি বিভিন্ন প্রকাশনা, ফোরাম ও বক্তব্যে সার্বক্ষণিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যথার্থই মন্তব্য করেছেন ‘বঙ্গবন্ধু যে মেহনতি মানুষের স্বার্থে বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তারাই তাকে প্রকৃত মূল্যায়ন কখনও করেননি।

তিনি শিক্ষক সমিতি নেতৃত্ব দিয়েছেন, দেশে-বিদেশে, সিনেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছে, ফাইন্যান্স কমিটির সদস্য হয়েছে, জার্নাল সম্পাদনা, পুরানো বিভাগের প্রধান ও নব-প্রতিষ্ঠিত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্ত হয়েছেন সমাজ পরিবর্তনের বহু লড়াইয়ে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বহু বার। তিনি লিখেছেন যে, ১৯৬৬ সালের প্রথম ভাগে লাহোরে ৬ দফা ঘোষিত হয়। লেখ মুজিব, ঢাকায় ফিরে এসে পার্টি কংগ্রেসে ৬ দফা আমাদের বাঁচার দাবি বলে ঘোষণা দিয়ে তা পাশ করিয়ে নেন।

তিনি একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেছেন। অন্যান্য নিদর্শন হিসাবে প্রথম কাতারের বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাস নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আসমান্য বঙ্গবন্ধু প্রেমিক হিসেবে দেশের সমৃদ্ধির ক্সেত্রে শিক্ষা উন্নয়নকে মূল মন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এখন শিক্ষা ক্ষেত্রে আমলারা ছড়ি ঘোরাতে ব্যস্ত রয়েছে।

প্রায় শতাধিক পেশাভিত্তিক লেখালেখি ছাড়াও তার অপেশাধারী বই রয়েছে ১৯টি যাদের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, দেশরত্ন শেখ হাসিনা, ঘাতক দালাল প্রসঙ্গ ইত্যাদি। এ যাবত কোনও সরকারি স্বীকৃতি কিংবা সরকারি পদবী না পেলেও দেশী-বিদেশী সম্মাননা সম্মান পেয়েছেন অগণিত।

দেশের অভ্যন্তরে একমাত্র উল্লেখযোগ্য সম্মাননা হচ্ছে বাংলা একাডেমীর ফেলোশীপ। ভারতের ব্যাঙ্গালোরে এমটিসি গ্লোবাল থেকে প্রফেসর ভোলানাথ দত্ত তাকে সম্মানী দিতে গিয়ে মন্তব্য করেন যে, ব্যবস্থাপনায় এক গভীর জ্ঞান তাপস। এমন একজন মানুষ যাকে বলা যায় অনন্য উৎপাদক বা প্রযোজক কিন্তু নিকৃষ্ট মানের বাজারজাতকারী। তিনি অন্তরালে থাকতেই ভালবাসেন।

আমি তাকে প্রায়শঃ বলেছি, আপনি নিজেকে প্রকাশ ও উন্মোচন করুন। তার জবাব হচ্ছে- মুখের ভাজগুলো ভেঙ্গে গেলে বিশ্রী দেখাবে, তাই জীবনে কোনদিন চাইনি। এটা তার অভিমান হয়ত তার অভিমানের কারণে তিনি ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি গ্রন্থে লিখেছেন যে, ক্লাসে ‘নেতৃত্বে’পড়াতে গিয়ে বাঙালির ইতিহাস চেতনাকে আরেকটু বাজিয়ে দেখতে চাইলাম।... ছাত্রছাত্রীদের প্রায় নব্বই শতাংশ বঙ্গবন্ধুকে তাদের প্রিয় নেতা বলে অভিহিত করেছেন।

গ্রন্থের শেষ ভাগে প্রকাশক কর্তৃক সন্নিবেশিত তার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত দেখলাম। মনে হলো তিনি হতে পারতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান কিংবা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান বা রাষ্ট্রদূত কিংবা বিবিধ কমিশনের চেয়ারম্যান। তবে এখনও সময় বয়ে যায়নি। তাই তাকে নির্দ্ধিধায় ইউজিসি চেয়ারম্যান, এ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, ইউজিসি অধ্যাপক বা জাতীয় অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। তাকে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দিয়েও সম্মানিত করা যায়।

গ্রন্থটি রচনার প্রেক্ষাপটে তার সাথে আলাপ করতে গিয়ে অনুভব করলাম, জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমি তাকে বললাম আবেদন করতে কেননা ‘বাচ্চা না কাঁদলে মা-ও দুধ দেয় না’। বলছি এ কারণে যে সাম্প্রতিক তিনি অনেকটা নির্জিব, নিশ্চুপ, অনেকটা আত্ম-নিমগ্ন। মনে হচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছেন নীরবে-নিভৃতে। আসলে সত্যিকার আওয়ামী লীগারদের একাংশ কিন্তু বামপন্থী ও নব্য কাওয়াদেরকারণে পুরবাসিনী হতে লেগেছেন।

তাকে তাই আবারও মূলধারাতে ফিরিয়ে আনার একান্ত প্রয়োজন। হয়ত আমার আবেদনে কেউ না কেউ সাড়া দেবেন। তার গ্রন্থটি পড়লেই বুঝা যাবে যে একজন একক মানুষের সমাজ ও শিক্ষার ক্ষেত্রে কি অপূর্ব অবদান রয়েছে। আমি তাকে নির্মোহ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

গ্রন্থটির প্রতিটি লেখায় ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ এবং তাকে নতুন প্রজন্মকে জানানোর অভিপ্রায়। কয়দিন আসা সাবেক এক জাসদ সমর্থক অর্থনীতির শিক্ষক যিনি ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকসে ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেজাই করিম খন্দকারকে যখন বঙ্গবন্ধুর সুপুত্রদ্বয় শেখ কামাল সাহেব এবং শেখ জামাল সাহেবের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যাচার করছিলেন এক পর্যায়ে বলতে বাধ্য হলাম, মিথ্যে না থামালে থাপ্পর মারব বয়োজৈষ্ঠ বলে সম্মান করব না। আসলে এরাই এখন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। আমার বাবা প্রয়াত প্রফেসর মোবাশ্বের আলীকে যিনি ভাষা সৈনিক ছিলেন, তার কাছে শুনেছি ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা। বঙ্গবন্ধুর নির্ভীকতার স্মৃতিগ্রন্থের পাতায় পাতায় ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

প্রফেসর . মুহম্মদ মাহবুব আলী, অর্থনীতিবিদ, উদ্যোক্তা বিশেষজ্ঞইমেইল: [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :