টুঙ্গিপাড়ায় এখনো চলে তালপাতায় পাঠদান
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার সাংবাদিক আমিনুল ইসলামের কাছে প্রথম জানতে পারি সংবাদটি। ডুমুরিয়া নামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে শিশুদের স্কুলে পড়াশোনা শুরুর আগে তালপাতায় পাঠদান করা হয়। সেই প্রাচীন রীতি- মাটিতে চাটাই পেতে বসে বাঁশের কঞ্চির মাথায় কালি লাগিয়ে তালপাতায় লেখা। পড়া হয় শতকিয়া, বাল্যশিক্ষা। মৌসুমে গ্রাম থেকে তোলা ধানে হয় শিক্ষকের বছরের বেতন।
পরদিন খুব সকালে ছুটলাম প্রাচীন ঐতিহ্যিক তালপাতার পাঠশালা দেখতে। গোপালগঞ্জ শহরের লঞ্চঘাট এলাকা থেকে গোপালগঞ্জ-বাঁশবাড়িয়া সড়কের লোকাল বাসে দেড় ঘণ্টা যাত্রা শেষে বাঁশবাড়িয়া বাজার। সেখান থেকে ভ্যানে ডুমুরিয়া গ্রামের জামাইবাজার সংলগ্ন ডুমুরিয়া সর্বজনীন দুর্গামন্দির। এখানেই তালপাতার পাঠশালা।
কেউ প্লাস্টিকের বস্তা, কেউবা খেজুরপাতার পাটি আবার কেউ পাটের বস্তা পেতে ৩০ জন শিশু হাত মকশো করছে তালপাতায়। শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ওই গ্রামের মহাদেব কীর্তনিয়ার স্ত্রী কাকলি কীর্তনিয়া।
পাঠশালার শিক্ষিকা কাকলি কীর্তনিয়ার ভাষ্য, টুঙ্গিপাড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম ডুমুরিয়ার একটি দুর্গা ও হরি মন্দিরে চলছে এই তালপাতার পাঠদান। এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আশপাশের গ্রামের অভিবাবকরা এখনো তাদের সন্তানদের প্রথমে এই পাঠশালায় পাঠান। এখানে ইংরেজি ও বাংলা বর্ণমালার হাতে খড়িসহ বানান ফলা, শতকিয়া ও বাল্যশিক্ষা শিখানো হয়। এসব শেখার পর শিশুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু বা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়।
মূলত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির উপযুক্ত করে তৈরি করা হয় এ পাঠশালায়। সরকারি কোনো সাহায্য ছাড়া সম্পূর্ণ স্থানীয় সাহায্য-সহযোগিতায় চলে এ পাঠশালা।
ধান কাটার মৌসুমে গ্রাম থেকে ধান তুলে শিক্ষককে বেতন হিসেবে দেয়া হয়। সারা বছরে প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষককে দেয়া হয় এক মণ করে ধান।
দেশ স্বাধীনের পর থেকে এই গ্রামে এখনো চলছে তালপাতার শিক্ষা। হাতে-মুখে কালি মেখে ছোট ছোট শিশুদের তালপাতার ওপর প্রথম বর্ণমালা শেখা মনে করিয়ে দেয় পুরনো আমলের সেই পাঠশালার কথা। টুঙ্গিপাড়ার এই গ্রামে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি পাঠশালা ব্যবস্থা চালু রয়েছে এখনো ।
শিশুসন্তানকে এই পাঠশালায় পাঠানোর বিষয়ে শিক্ষার্থী আঁখি কীর্তনিয়ার বাবা সনাতন কীর্তনিয়া বলেন, এলাকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তালপাতায় শিক্ষকের এঁকে দেয়া বর্ণমালার ওপর হাত ঘুরিয়ে বর্ণমালা লেখা শেখে। এখানে আসতে আসতে তারা বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালা শিখে ফেলে। এতে হাতের লেখা ভালো হয়। তাছাড়া এসব পাঠশালায় বাল্যশিক্ষাও শেখানো হয়, যা শিশুদের বেড়ে উঠতে এবং চরিত্র গঠনে প্রাথমিক ধাপ হিসেবে কাজ করে।
ডুমুরিয়া গ্রামের আনন্দ কীর্তনিয়া, দীলিপ কীর্তনিয়া, গোবিন্দ বিশ্বাস গৌর মন্ডলসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, তারাও এই পাঠশালায় পড়েছেন। এরপর তাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা এখানে আসে। এ পাঠশালায় হাতেখড়ি নিয়ে যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে, তা তাদের অনেক কাজে লেগেছে। বিশেষ করে তাদের হাতের লেখা অনেক সুন্দর হয়েছে।
ডুমুড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সুকুমার বাইন জানান, টুঙ্গিপাড়া উপজেলার এই গ্রামটি নিচু অঞ্চল। গ্রামের দরিদ্র মানুষের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য দেশ স্বাধীনের পর এলাকার শিক্ষানুরাগী রথীন্দ্রনাথ মালো এ পাঠশালা গড়ে তোলেন। তিনি এলাকার বিভিন্ন গাছতলা, কারো বাড়ির আঙিনায় ঘুরে ঘুরে পাঠশালা চালিয়েছেন। এখন পাঠশালাটির স্থান হয়েছে দুর্গামন্দিরে।
রথিন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর পাঠশালাটির দায়িত্ব নেন মীরা কীর্তনিয়া নামে এক নারী। মীরা কীর্তনিয়া বছর দুই আগে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে চলে গেলে বর্তমানে দায়িত্বে রয়েছেন কাকলি কীর্তনিয়া।
কাকলি নামে মাত্র বেতনে এই দায়িত্ব পালন করছেন। সরকার বা কোনো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা যদি এলাকার দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের কথা বিবেচনা করে একটি স্থায়ী জায়গা বা ঘর করে দেয় এবং শিক্ষকের বেতনের ব্যবস্থা করে তাহলে প্রাচীন ঐতিহ্যিক পাঠশালাটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
এই পাঠশালার শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষিকা কাকলি কীর্তনিয়া জানান, তিনি তালপাতায় প্রথমে বর্ণমালা খোদাই করে দেন। শিক্ষার্থীরা নিজেরা নারিকেলের খোসার কয়লা ও কাঠের কয়লা গুঁড়ো করে কালি বানায়। আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কলম তৈরি করে। কলমে কালি লাগিয়ে তারা তালপাতায় খোদাই করা বর্ণমালার ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লিখে। লিখতে লিখতে শিখে যায় বর্ণমালা। এরপর তাদের বানান, ফলা ও শতকিয়া লেখা শিখানো হয়। সবই তালপাতায় লেখানো হয়। এতে তাদের হাতের লেখা ভালো হয়। যেসব শিশু প্রথম দিকে কাগজ আর কলম দিয়ে লেখা শেখে তাদের হাতের লেখা সুন্দর হয় না।
এ ছাড়া পাঠশালার শিশুদের বাল্যশিক্ষা বই পড়ানো হয়। প্রতি শুক্রবার পাঠশালার শিশুদের গীতাপাঠ ও নাচ-গান শেখানো হয় বলে জানান কাকলী। এখানে কাঠি গ্রাম, কানাই নগর, ভৈরব নগর, ছোট ডুমুরিয়া ও বড় ডুমুরিয়া প্রভৃতি গ্রামের শিক্ষার্থীরা এখানে শিক্ষা নিতে আসেন।
(ঢাকাটাইমস/৩মার্চ/মোআ)