বইমেলা: একটি পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত প্রতিবেদন

মনদীপ ঘরাই
 | প্রকাশিত : ০৪ মার্চ ২০১৯, ১৩:১৬

আমি নিম্নস্বাক্ষরকারী ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ থেকে শুরু হওয়া বইমেলায় সঙ্গীয় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সহকারে সরেজমিন পরিদর্শনে যাই। একবার নয়। বারবার যাই। পরিদর্শনের নামে আমার লেখা বইয়ের পাঠক খুঁজতে যাই। অন্যের বইয়ের হালচাল জানতে যাই।

একজন সরকারী কর্মচারীর কাছ থেকে এমন সূচনা ছাড়া অন্যকিছু কেন আশা করছিলেন? বইমেলা হোক আর ম্যালা বই হোক, তদন্ত প্রতিবেদন তো এমনই হওয়ার কথা, তাই না? মনে মনে ভাবছেন তো, তদন্ত করার তুমি কে হে?

বা রে! আপনারা যে কোন বিষয়ে ফেসবুকে বসেই বিচার করে ফেলতে পারেন, আর আমি একটা তদন্ত করলে দোষ?

শুরু থেকেই শুরু করি। বইমেলার এ তদন্তের প্রথম পক্ষে আছে লেখক, কবি, সাহিত্যিকেরা। আর দ্বিতীয় পক্ষে আছে পাঠক, দর্শক, মিডিয়া, রেস্টুরেন্ট মালিক, বিকাশ এবং অন্যান্যরা।

অভিযোগটা কি? তদন্তই বা কিসের?

তদন্তটা দ্বিতীয় পক্ষের একজন পাঠকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে। উনি ধা চকচকে এক কাভার এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত এক মুখের ওপর ভরসা করে বই কিনতে গিয়ে কেজি দরে ফেসবুক স্ট্যাটাস কিনে ঘরে ফিরেছেন। তিনি হতাশ। তিনি টাকা ফেরত চান।

ফেরত চাইলেই কি আর মিলবে? মেলে নি। এখান থেকে শুরু। এর পর একে একে বের হতে থাকে বইমেলার নানান রূপ।

দোষ কার? লেখকের? নাকি পাঠকের?

এবারের বইমেলা নতুন এক ধারার উদ্ভব দেখেছে। লেখকেরা ধুন্ধুমার প্রচারণা চালিয়েছেন ফেসবুক, মেসেঞ্জার ইনবক্স আর গ্রুপে গ্রুপে(আমিসহ)। ওদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার সেলিব্রিটিরা চলে এসেছেন লেখালিখির জগতে। যার ফলে, লোকজন দাম দিয়ে সেলফি আর অটোগ্রাফ কিনেছে সবথেকে বেশি। এ তো গেল লোকজনের হিসেব। পাঠকেরা কিন্তু ঠিকই তাদের পছন্দের লেখকের লেখা খুঁজেছেন, কিনেছেন, বাসায় গিয়ে পড়েছেন।

আর লোকজনের হিসেবটা ভিন্ন। সবার চেয়ে উৎসাহ বেশি নিয়ে বই কিনেছেন,লেখকের সাথে তুলেছেন সেলফি, বাসায় গিয়ে দিয়েছেন ছবিসহ স্ট্যাটাস.....এরপর বই নিয়ে পড়েছেন মহাবিপদে। রাখতেও ঝামেলা, ফেলতেও লজ্জ্বা। শেষমেষ বাসার ছোট্ট বাবুকে নৌকা বানানোর জন্য দিয়েছেন, সে ও রাজি হয় নি। তখন ওনারা বিলাপ করেছেন, " ধুর, টাকাটাই পানিতে"

পাঠক আর লোকজনের মাঝে এক পার্টি আছে। এরা সেমি-পাঠক। বই কিনেছে। চারপৃষ্ঠা পড়েছে, ব্যাস। রিভিউ লেখা শেষ। সাথে বইয়ের পাশে ফুলের ছবি, চুলের ছবি দিয়ে লেখককে ট্যাগ করে লিখবে feeling hopeful with xyz।

এবার শেষ দল। এরা সংখ্যায় ভারি। এরা দর্শক। যদিও বইমেলায় কোন সিনেমা, নাটক ছিল না, তবুও এরা সব দেখতেই গিয়েছে। কি দেখলো এতো? উল্টো জিজ্ঞেস করেন কি দেখেনি। জালি লাউ চেক করার মতো করে এক বই হাজার বার দেখতে দেখতে বইয়ের কাভার ময়লা করে ফেলেছে। তবে বই কেনে নি।আর কিনবেন কিনা জিজ্ঞেস করলেই বলেছে, "দেখি!" ওনারা শুধুই দেখেছেন। ফোয়ারা, শিশু চত্বরে বাচ্চাদের লাফালাফি, সুন্দরী ললনা, টিভির লাইভ....ওনারা শুধু দেখেছেন।

এ পক্ষের বাকিদের মধ্যে আছে অতন্দ্র প্রহরী "বিকাশ"। মেলায় ঢুকলে রোজ এদের একই প্রশ্নের প্রিলি পরীক্ষা পাশ করতে হয়েছে।

" আপনার কি বিকাশ অ্যাকাউন্ট আছে?"

এতবার কেউ আমার বয়স বা বেতনও জিজ্ঞেস করে নি।

মেলায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে? এককথায় কফি।

বইটই কে ছাড়িয়ে গেছে কফির আড্ডা। পরের বার থেকে ভাবছি বেস্টসেলার হওয়ার জন্য কফির কাপের গায়ে লিখবো। লোকজন কফি কিনলো না কবিতার বই কিনলো কনফিউজ হয় তো হবে, তবে আমি তো বেস্টসেলার!

এবার লেখকদের দিকে ফিরি। আমার মতো যারা শুরু করছেন, তারা শুরুতেই বাজিমাতের চিন্তা করে মেলায় যেয়ে হোঁচট খেয়েছেন নিশ্চয়ই। অনেকে না ও মানতে পারেন, কিন্তু ফেসবুকের ফলোয়ার আর ক্রেতার সংখ্যা ব্যস্তানুপাতিক। তবে, আপনার লেখার বাইরে ফেসভ্যালু থাকলে হিসেবটা অন্যরকম হতে বাধ্য।

হঠাৎ একজন লোক এসে বললেন, " কবিতা পড়া হয়?"

আমি বললাম, "হয়"

উনি বললেন, "তাহলে আমার এই বইটা কিনতে পারেন"

এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়েই থাক।

যারা পরিণত ও নামকরা লেখক, তাদের প্রসঙ্গে আলোচনাটা অহেতুক হবে। তারা শুধু লেখা দিয়েই টিকে আছেন বছরের পর বছর, পাঠকের পর পাঠক নিয়ে।

শেষে এসে প্রশ্ন করুন, জানি তো করবেন, " সবই বুঝলাম, দোষটা কার?"

দোষটা যারই হোক, শাস্তি সবাইকে পেতে হবে। এ আবার কেমন বিচার? ইহা ফেসবুকীয় বিচার। দু দফা বৃষ্টির শাস্তি কে পান নি বলেন তো? লেখক, প্রকাশক, কফির দোকানদার....বাদ যায় নি একটি শিশুও।

এ তো গেল প্রাকৃতিক শাস্তি। আর মানবসৃষ্ট শাস্তি তো রয়েই গেল। এবড়ো থেবড়ো ইটে আনমনে একবারও কি হোঁচট খাননি এমন লোক পাওয়া যাবে কি?

তবে কি শুধু শাস্তিই দিয়ে গেল বইমেলা? একদম না। দু' দিনের সময় বর্ধন ভুলে গেলেন এত তাড়াতাড়ি?

এই তো তদন্ত। এই তো প্রতিবেদন। সার্বিক মন্তব্য শুনবেন না? আমার মতো যারা শুরু করলেন, তাদের বলবো:

হাল ছাড়াটা ঠিক হবে না। লিখুন। যা মন চায় লিখুন। রান্নার বই, কান্নার বই, রাতের বই, হাতের বই, আবেগের বই, বিবেকের বই, দ্রোহের বই, গ্রহের বই...

কিন্তু লিখুন। আগামীর দিনগুলোতে আমাদেরই তো আগলে রাখতে হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে।

বিদায় বইমেলা। অপেক্ষা পুরো এক বছরের।

মনদীপ ঘরাই: সিনিয়র সহকারী সচিব এবং লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :