মিশ্র ব্যবস্থাতেই এগিয়ে নিতে হবে পুরান ঢাকা

প্রকাশ | ০৫ মার্চ ২০১৯, ১৫:২৩

মোহাম্মদ আজিম বখশ

মোহাম্মদ আজিম বখশ। ঢাকার আদি বাসিন্দা। ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান। ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য সুরক্ষায় পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন। চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিদুর্ঘটনার পর পুরান ঢাকা নতুন করে গড়ে তোলার যে দাবি উঠেছে, তা নিয়ে ঢাকা টাইমসএই সময়-এর সঙ্গে কথা বলেছেন মোহাম্মদ আজিম বখশ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তায়েব মিল্লাত হোসেন

চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকার পুনর্নির্মাণ, আধুনিকায়ন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কী বলবেন?

আসলে পুরান ঢাকার যে ঐতিহ্য সেটাকে চাইলেই কিন্তু আধুনিক ঢাকা বানানো যাবে না।

কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত তো করতে হবে। জনবসতিতে কেমিক্যাল থাকা কী উচিত?

এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ধরন, কেমিক্যালের ব্যবসা কোনটা বিপজ্জনক কোনটা বিপজ্জনক না- এটা চিহ্নিত না করে এ বিষয়ে তো বলা মুশকিল। কারণটা হলো কেমিক্যালকে অবশ্যই দুর্ঘটনার আওতা থেকে বের করে আনতে হবে। সরিয়ে নিতে হবে। আবার কেমিক্যালকে তো বন্ধও করা যাবে না। কন্ট্রোল করতে হবে। কেমিক্যালের যে ব্যবসা তার সমাধান বাস্তবসম্মত হতে হবে। এর সঙ্গে পুরান ঢাকার মতো ঘিঞ্জি এলাকা প্রশস্ত করার কিন্তু কোনো সুযোগ নেই বা খুবই কম। একেকটা বাড়ি এখানে আধা কাঠা, এক কাঠা। সেই বাড়ি প্রশস্ত করতে গেলে পুরো মহল্লায় কাজ করতে হবে।

সে ক্ষেত্রে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধের উপায় কী?

এখন যদি মনে করেন এই রাস্তার মধ্যে, যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও আমাদের পুরান ঢাকার মদন সাহা লেনে- এই গলির মধ্যে কিন্তু বড় বড় ট্যাঙ্ক করা ছিল। পাকা সেই ট্যাঙ্কের মধ্যে পানি ছিল। আগুন লাগলে তা ব্যবহার করা হতো। সম্প্রতি আমি ফায়ার ব্রিগেডের মোটরসাইকেলে আগুন নিভানোর যন্ত্র দেখেছি। এগুলো নিয়ে তারা হাতিরঝিলে বসে থাকে। এগুলো নিয়ে তাহলে ঘিঞ্জি গলিতে আগুন নেভাতে অসুবিধার কিছু নেই। পুরান ঢাকায় ফায়ার সার্ভিস এভাবে কাজ করতে পারে ইচ্ছা করলেই।

মিশ্র একটা অবস্থার মধ্যে দিয়েই কী পুরান ঢাকা টিকে থাকবে?

এই যে মিক্স কালচার- যেমন নিচে দোকান আর উপরে বাড়ি। কোন দোকানগুলো বিপজ্জনক, কোন কেমিক্যালগুলো বিপজ্জনক- এগুলো নির্ধারণ করতে হবে। এখন যেমন শোনা যাচ্ছে উপরের যে ইলেকট্রিক লাইন এগুলো নাকি মাটির নিচে দিয়ে নেওয়া হবে। যে রকম খোঁড়াখুঁড়ি হয়, তাতে কি এটা নিরাপদ হবে? অন্য শহরগুলোতে যেমন পুরোনো শহর দিল্লি, এরকম বহু শহর আছে ভারতে। এখন যেমন ঢাকার বাইরে অর্থাৎ অন্য শহরগুলোতেও জলজট হচ্ছে। কেন? আগে একটা দোকান থেকে আরেকটা দোকানের দূরত্ব ছিল অন্তত ১০-১৫ হাত। কিন্তু এখন তো কোনো ফাঁক থাকছে না, লাগালাগি দোকান হচ্ছে। দোকানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। যার জন্য পানি সরছে না, জলজট হচ্ছে।

চকবাজারের শোকাবহ ঘটনার পর তো পরিবর্তনের কথাই বেশি হচ্ছে।

এভাবে মৃত্যুটা তো কারও কাম্য হওয়া উচিত নয়। আবার পুরান ঢাকাকে যদি সুন্দর প্লানিংয়ের মধ্যে আনতে হয় তবে মাথা থেকে এটা উড়িয়ে দিতে হবে যে, পুরান ঢাকায় আমরা নতুন ঢাকার মতো বড় বড় রাস্তা বানাবো। এটাও সম্ভব না। দুটো মিলিয়ে কি করা যায়। সে জন্য আমাদের এই বাস্তবতার যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো দেখতে হবে। কোথায় দোকান থাকতে পারে, কোথায় পারে না- এগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে।

পুরান ঢাকায় ঘনবসতি তো একটা সমস্যা। এটা কি করে দূর করা যায়?

ঘনবসতি দূর করার কোনো সুযোগ নেই। আসলে উপরের দিকে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যেমন চকবাজারের কথাই বলি। এখন যে চকবাজার এটা কিন্তু আগে ছিল না। ওখানে আগে ছিল কি? একটি ভিটি ছিল। একটা দোকান যার আয়তন ছিল সাত ফুট বাই আট ফুট। এখন এরকম তিনটি দোকান দিয়ে আটতলা ভবন হইছে। জায়গা কম থাকায় আসলে এই অবস্থা। তাই একেবারে আধুনিক করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। মানুষজনকে ঘরছাড়া করাও সম্ভব না। এখন কেমিক্যালের গোডাউন বলেন বা অন্য গোডাউন- যেগুলো আগুনের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে এগুলো কন্ট্রোল করতে হবে। কন্ট্রোলে আনতে হলে কিন্তু সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

তাহলে মিশ্র অবস্থা থেকেই যাবে?

পুরান ঢাকায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প-কারখানা- এগুলো আলাদা করার সুযোগ কম। কারণ জায়গায়ই কম। অন্যদিকে দেখুন, নতুন ঢাকার গুলশান কি আবাসিক এলাকা হয়েছে? হয়নি। গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডি- কোনোটাই কিন্তু আবাসিক থাকেনি। তাহলে পুরান ঢাকাকে আপনি আবাসিক বানাবেন কি করে। পুরান ঢাকার লোকজনের জীবিকাও কিন্তু ওই দোকানগুলো। কিন্তু কোন দোকানগুলো বাড়ির নিচে রাখা যাবে আর কোনগুলো রাখা যাবে না, সেটা অবশ্যই ঠিক করতে হবে।

রাজউক তো একটা পরিকল্পনা করেছিল কমিউনিটিভিত্তিক পুনর্নির্মাণ।

সরকার অবশ্যই উদ্যোগ নিতে পারে। যেমন বংশালে যেটা করতে চায় কমিউনিটিভিত্তিক উন্নয়ন। অর্থাৎ কয়েকজনের ছোট জায়গা একসঙ্গে করে বড় ভবন নির্মাণ। এটা হবে না। কারণ কেউ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে চাইবে না। সেটা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও। কারণ ভিটে ছেড়ে আবার ফ্ল্যাট পাবে, এ বিশ্বাস মনের ভেতরে আনা কঠিন। আর বংশালের আরো একটি বিষয় হচ্ছে, নর্থ সাউথ যে রোডটা বংশালের উপর দিয়ে হয়েছে খালগুলো বন্ধ করে, ওটা কিন্তু পর্যাপ্ত রাস্তা। ওখান থেকে যদি বাম দিকে যান অর্থাৎ গুলিস্তানের দিকে যান সদরঘাট থেকে তা হলে ডান দিকে হলো মালিটোলা এলাকা। বাম দিকে হলো বংশাল এলাকা। যদি তাকান তা হলে দেখবেন মালিটোলা অঞ্চলটা মোটামুটি ঘিঞ্জি। ছোট ছোট বাড়ি। কিন্তু বংশালটা বড়। তার মানে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল। ওখান থেকে ভিতরে কতটুকু জায়গা। ওখান থেকে তো বড় রাস্তায় আসার সুযোগ রয়েছে এখন, যেটা আগে ছিল না। আর কমিউনিটি বেইজ যে উন্নয়ন প্রকল্প, যেটার মূল অসুবিধাটা হলো যে সব পদক্ষেপ সরকার নেয় সেগুলোর কাজ কবে শেষ হবে, এটা কেউ জানে না। এজন্য মানুষ আস্থার সংকটে থেকে যায়।

উন্নয়ন কাজের সময় বাসাভাড়া সরকার দিবে, এ রকম একটা কথা ছিল।

এটা কি কেউ বিশ্বাস করেছে? বিষয়টি স্বচ্ছভাবে হবে কি না কেউ সেটায় ভরসা রাখতে পারছে না। মূল কথাটা হলো পৈতৃক ভিটা ছেড়ে বেশির ভাগ মানুষই যেতে চায় না। যেমন এখন পুরান ঢাকার অনেকেই নতুন ঢাকাতে ভাড়া থাকে স্কুল-কলেজের সুবিধার জন্য। কিন্তু তারা পুরান ঢাকা থেকে রোজগার করছে। আর নতুন ঢাকায় ভাড়া দিয়ে থাকছে। আবার আগের প্রসঙ্গে আসি, মিশ্র ব্যবহারের কথাটা যে বলা হচ্ছে এটা কিন্তু সারা দুনিয়াতেই আছে। এখন কথা হলো নিচে দোকান বা মার্কেট ওটা কিসের দোকান বা মার্কেট হবে সেটা নির্দিষ্ট থাকতে হবে। ওই জায়গাটা নির্দিষ্ট না রাখতে পারলে কোনো লাভ নেই। পুরান ঢাকার চেয়ে নতুন ঢাকায় নতুন নাগরিকদের যেতে উৎসাহিত করতে হবে। যেমন চকবাজারে যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে পাঁচজন ঢাকাইয়া। অন্যরা নতুন নাগরিক। তাদের প্রায় সবাই ভাড়াটিয়া। ব্যবসায়ীদের পরিচয়ের ক্ষেত্রেও চিত্রটা এই রকম। বাড়ির মালিকের পক্ষে ভাড়া দেওয়াটা এটাও কিন্তু একটা কঠিন কাজ। যে লোকটা ভাড়া নিয়েছে সে কেমিক্যালের গোডাউন করার জন্য ভাড়া নিয়েছে এরকম কিন্তু নাও হতে পারে। কাজেই যেটা মানুষের জন্য সুবিধাজনক এটাই করতে হবে।

তাহলে পুরান ঢাকার সমস্যার সমাধান কী?

এলাকাবাসীর মত নিয়ে, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকে না। সে জন্য দেখেন পুরান ঢাকায় অনেক দোকান হয়েছে। রেস্টুরেন্টের মধ্যে কিন্তু আগুনের কাজ আছে। যেগুলো সারা রাত খোলা থাকে। নিশ্চয়ই এখানে মানুষ খাবার খায়। চলেও, না হলে তো দোকান খোলা রাখা সম্ভব ছিল না। সেজন্য মিশ্র ব্যবসা কিন্তু থাকবে। ঘিঞ্জিটাও থাকবে, এটা দূর করতে পারবেন না। কারণ উপরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এখন তো হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে। কারণ একটা ভবন যদি সাত-আট তলা হয় নিচে থেকে কতটুকু কাভার করতে পারে। বাংলাবাজার এলাকা আমরা পাকিস্তান আমলেও দেখেছি একেকটা দোকানের নিচে একটা করে বৈঠকখানা ছিল। ওই বৈঠকখানাটা এখন দোকান হয়েছে। পুরো বাড়িটা হয়েছে মার্কেট। সমস্যা তো থাকবে। সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে হবে। পথটা হলো মানুষের যেন ক্ষতি না হয়, আগুন লেগে গেলে সেটা নিভানোর চিন্তা করতে হবে। আবার তাদের বাড়িঘর ভেঙে বড় বড় রাস্তা তৈরি হয়ে গেল, এটাও কিন্তু সম্ভব না। সবটা মিলেই এগিয়ে যেতে হবে, পুরান ঢাকাকে এগিয়ে নিতে হবে।

আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকাটাইমস এই সময় পরিবারের সবাইকে শুভেচ্ছা।