৭ মার্চের ভাষণ, ইতিহাস বদলের ভাষণ

ড.কাজী এরতেজা হাসান
| আপডেট : ০৬ মার্চ ২০১৯, ২১:২৯ | প্রকাশিত : ০৬ মার্চ ২০১৯, ২১:২১

হাজার হাজার বছরের বাঙালিত্বের স্বাধীন আত্মপ্রকাশের রূপরেখা ও পথনির্দেশ যে চিরঞ্জীব ঐতিহাসিক ভাষণে বিধৃত, সেটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চ এর ভাষণ। ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো সেই অবিস্মরণীয় ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বপ্রেক্ষিতে এটি এক সুমহান জাতীয় অর্জন। সেইসাথে যারা ইতিহাস বিকৃত করে, ইতিহাস পাথরচাপা দেয়, এই ঐতিহাসিক স্বীকৃতি তাদের গালে সরাসরি চপেটাঘাত।

প্রসঙ্গত: মুজিব আরবি শব্দ। এর অর্থ উত্তর দেয়া, জবাব দেয়া। জাতির ওপর সেই সময় যত অন্যায় হয়েছিল, জাতির যত প্রশ্ন ছিল- সব প্রশ্নের উত্তর দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ভাষণে।

যারা ৭ই মার্চের ভাষণের বিষয়বস্তু এবং পূর্বাপর ঘটনাবলি হিসাবে না-নিয়ে ভাষণের মধ্যে খুঁত ধরার চেষ্টা করেন,তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, বঙ্গবন্ধু এই ভাষণে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা-আন্দোলনে অভাবনীয় উঁচুমাত্রার রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়োগ করেন। শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতার প্রশ্ন ফয়সালা করেন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ দিয়েছেন, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। আর এই ভাষণ শুধু ভাষণ নয়; পরের দিন ৮ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ রাত পর্যন্ত্ম কী ফলাফল ছিল, তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে।

জাতীয় প্রেক্ষাপট: সেইসময় বাঙালির জাতীয় প্রেক্ষাপট কী ছিল ? অতীতে ৪টি বিজয় অর্জন হয়, ’৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ’৫৪-র নির্বাচনে বিজয়, ’৬৯-র অভ্যুত্থান, আর ’৭০-র মহানির্বাচনী বিজয়। আবার এই চারটি বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তিনটি মহাষড়যন্ত্র পাকিস্তানিরা করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজানো এবং ’৭০-র নির্বাচনী বিজয় বানচালের জন্য পয়লা মার্চ সংসদ-অধিবেশন বাতিল করে দেয়া। এছাড়া, মাথার ওপর পাকিস্তানিদের পাকিস্তান ভাঙার অভিযোগ ছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ ছিল।

চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। গণপরিষদে সংবিধান রচনার উদ্যোগ হয়। কিন্তু মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৫৬ দিন। পাকিস্তানি জান্তার ষড়যন্ত্রে প্রথমে ইস্কান্দর মির্জাকে গভর্ণর করে পাঠানো হয়। পরে আইয়ুব খানের সামরিক হস্তক্ষেপে ’৫৪-র বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়।

ছেষট্টি সালে বঙ্গবন্ধু ছয়দফা দেন। এটি ছিল স্বশাসনের প্রস্তাব। এটি নৎসাত করতে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ৫৪ সালের বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার পর এটি ছিল পাকিস্তানের দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র।

’৬৯ এ গণঅভ্যত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পতন ঘটে এবং আইয়ুব খানের সংবিধানটাও বাতিল হয়ে যায়। এক মাথা এক ভোট নীতিটি প্রতিষ্ঠিত হয়, গণপরিষদে সংবিধান রচনার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সংবিধানটি রচনায় যাতে বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার বিধিবদ্ধ থাকে, সেই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ’৭০ এর সাধারণ নির্বাচনকে গণরায়ে পরিণত করলেন, গণপরিষদে অর্জন করলেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ৬দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সরকার গঠন। তাই ’৭০ সালের নির্বাচনটি কোনো গতানুগতিক নির্বাচন ছিল না।

পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দেখল, গণপরিষদে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ৬দফা অন্ত্মর্ভূক্ত করবেন, বাঙালিরা স্বশাসন পাবে। শুধু অভিন্ন প্রতিরক্ষা আর পররাষ্ট্র নীতি ছাড়া পূর্ব বাংলা চলবে নিজের মতো। তারা তা হতে দিতে পারে না। আর এজন্যই গণপরিষদে অধিবেশন ১লা মার্চ বসার কথা থাকলেও ইয়াহিয়া খান তা নাকোচ করে দেন।

বঙ্গবন্ধুর এ উদ্দেশ্য যাতে সফল না হয়, সেজন্যই ইয়াহিয়া খান পহেলা মার্চে গণপরিষদের অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করে। এভাবেই আবার ছিনতাই হয়ে যায় বাঙালির গণরায়। তখন সারাদেশে বিড়্গোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২রা মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলা পতাকা। ৩রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টন মযদানে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ইশতেহার। সুতরাং ৭ই মার্চ তিনি যখন মঞ্চে দাঁড়ালেন, তখন স্বাধীন বাংলার পতাকা এসে গেছে, জাতীয় সংগীত এসে গেছে, এসে গেছে স্বাধীনতার ইশতেহারও।

৮ই মার্চ থেকে তিনি অসহযোগ ডাক দিলেন। এই অসহযোগ গান্ধীর অসহযোগ নয়, দেশের কর্তৃত্বই নিয়ে নিলেন। অসহযোগ পাকিস্তানের সাথে, আর দেশ পরিচালনার জন্য নিলেন কর্তৃত্বভার। কিভাবে অফিস, আদালত, ব্যাংক চলবে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারিবাহিনী কিভাবে কাজ করবে, জনগণ কি করবে-সকল নির্দেশনা দিয়ে দিলেন। পূর্ব বাংলার রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই পাকিস্তানি নির্দেশ অমান্য করে বঙ্গবন্ধুর জারিকৃত ফরমান অনুযায়ী চলা শুরম্ন করে।

ভাষণের শেষে বঙ্গবন্ধু দু’টো সংগ্রামের কথা বলে বাঙ্গালি জাতিকে নিয়ে তার দর্শন তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ ভৌগলিক স্বাধীনতার সাথে তিনি শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত হবার সংগ্রামের কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষ ও সমাজের মুক্তির কথা বললেন তিনি।

২৫ মার্চের রাতে বাংলাদেশ আক্রমণ ছিল পাকিস্তানের চার নম্বর চক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু এই চক্রান্ত পূর্বেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি দেখেছেন এর আগে ’৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালিদের বিজয় কিভাবে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, ’৬৬ সালে তাকে মিথ্যা মামলায় হত্যার চক্রান্ত্র করা হয়েছে আর ’৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েও বাঙালিদের গণপরিষদে বসতে দেয়া হচ্ছে না। অতীতের তিন চক্রান্ত্রের জালে বাঙালিদের আটকে রাখলেও আর কোনো চক্রান্ত্মে যাতে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের দমিয়ে রাখতে না পারে, সেজন্যই ৭ই মার্চ মঞ্চে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালিরা যাতে সরাসরি চক্রান্ত্র বানচাল করে স্বপ্নের স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে, তার ভাষণে সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পথই দেখালেন তিনি। আর পিছু ফেরা নয়, আর বঞ্চনা নয়, নয় শোষণ আর লাঞ্ছনা, এবার স্বাধীনতা, এবার মুক্তি।

ছোটবেলা থেকেই মায়ের কণ্ঠে সুরা ইয়াসিনের তেলওয়াত শুনে শুনে বড় হয়েছি। এরপর সবচে শ্রুতিমধুর যে ভাষণটি আমার হৃদয়কে আজো আন্দোলিত করে সেটি হচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ। তেজোদীপ্ত এই ভাষণটি যতবার শুনি ততবারই আমি উদ্বেলিত হই। একটি ভাষণেই বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতিসত্বার পরিচয় দিয়ে গেছেন। সেই মহান ভাষণটি থেকেই আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং লাল সবুজের পতাকা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শিক সন্তান হিসাবে আমি কখনোই তাকে অবমাননা করা হলে চুপ করে বসে থাকতে পারি নি। কয়েকমাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বইয়ে জাতির জনককে অবমাননা করা হলে নিজের ক্ষতি হবে জেনেও হাইকোর্টে রিট করি। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বইয়ে উপেক্ষিত করে চরম অন্যায় করেছে। মহামান্য হাইকোর্টও এ বিষয়ে ইতিমধ্যে রায় দিয়ে বলেছেন, বিষয়টি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধিক্কার জানিয়ে বইটি বাজারজাতকরণ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন।

আর এ অজস্র কারণেই ৭ই মার্চের বজ্র কণ্ঠের বঙ্গবন্ধু কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি নন। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন-একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি দেশ, বাঙালি জাতীয়তার একটি মহাকাব্য, একটি আন্দোলন, জাতি নির্মাণের কারিগর, ঠিকানা প্রদানের সংগ্রাম, একটি বিপ্লব, একটি অভ্যূত্থান, একটি ইতিহাস, বাঙালি জাতির ধ্রম্নবতারা: জাতির উত্থান, রাজনীতির কবি, জনগণের বন্ধু, রাষ্ট্রের স্থপতি, স্বাধীনতার প্রতীক, ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির অমর পিতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমর এই ভাষণটি হৃদয়ে আজীবন ধারণ করে যাবো বলে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করছি।

লেখক: ড. কাজী এরতেজা হাসান

সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা,

সদস্য, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য ও ধর্ম বিষয়ক উপকমিটি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :