হালদায় ভারী নৌযানে হুমকিতে মৎস্য প্রজনন ও ডলফিন

প্রকাশ | ০৯ মার্চ ২০১৯, ০৮:৩১

চট্টগ্রাম ব্যুরো, ঢাকাটাইমস
রাউজানে হালদা নদীতে ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযানের আঘাতে মৃত ১২ কেজি ওজনের কাতলা মাছ

এশিয়ার কার্পজাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে হুমকির মুখে পড়েছে মা মাছ। নদীতে বালি উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত ড্রেজারসহ ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযানের অবাধ চলাচলের সময় আঘাতে মৃত মাছ ভেসে উঠছে একের পর এক। এ ছাড়া অবৈধভাবে শিকার করা হচ্ছে মা-মাছ।

গত ৪ মার্চ হালদা নদীর অংকুরিঘোনা ও আমতোয়া এলাকায় দুটি মৃত মাছ উদ্ধার করে হালদা নদী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা সংগঠন ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) স্বেচ্ছাসেবকরা। ১২ কেজি ওজনের কাতলা মাছটি রাউজানের অংকুরীঘোনা এলাকায় এবং ৪ কেজি ওজনের আইড় মাছটি হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শার আমতোয়া এলাকায় পাওয়া যায়।

আইডিএফের কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন বলেন, মৃত মাছ দুটি তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভারস রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যান। এগুলোর দেহে ভারী নৌযানের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

তিনি জানান, হালদায় মাছ শিকারের অপরাধে গত ৪ ও ৫ মার্চ অভিযান চালিয়ে নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ২০ হাজার মিটার ভাসা ও ঘের জাল জব্দ করে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। পরে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়।

হালদাপারের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের জন্য বিখ্যাত হালদা নদীতে একের পর এক মৃত মাছ ভেসে ওঠায় স্থানীয় মাছের ডিম আহরণকারীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। হালদাপারের অনেক পরিবার এই নদীর ডিম সংগ্রহের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বছরের অন্যান্য সময় পরিবারগুলোর পুরুষরা ছোটখাটো কাজকর্ম করেন, তবে মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুমে হালদা নদী থেকে সংগৃহীত ডিম রেণুতে রূপান্তর করে বিক্রির টাকায় সংসার চালান তারা।

হালদা নদীর মাছের ডিম সংগ্রহকারী রোসাঙ্গীর আলম বলেন, এভাবে নির্বিচারে হালদার নদীতে ভারী নৌযানের উপদ্রব বন্ধ না হলে মৎস্য প্রজনন ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে।

স্থানীয়রা জানান, রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম হোসেন রেজা ও হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিনের নেতৃত্বে হালদায় দফায় দফায় অভিযান চালানো হলেও বন্ধ করা যাচ্ছে না ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযান চলাচল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ও হালদা রিভারস রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, হালদা থেকে ৪ মার্চ উদ্ধার হওয়া কাতলা ও আইড় হালদা রিভারস রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষণ করেছেন তারা।

আগামী এপ্রিল মাসে হালদা নদীতে রুইজাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) মা-মাছ ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ফলে নদীতে মা-মাছের আনাগোনা বেড়েছে। হালদা নদীতে ড্রেজারসহ ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযান চলাচল বন্ধ করা না গেলে হালদার মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি হুমকির মুখে পড়বে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাউজান উপজেলার মৎস্য অফিসে অতিরিক্ত দায়িত্বরত হাটহাজারী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘হালদায় একের পর এক মা-মাছ মারা যাওয়ার ঘটনায় নদীতে ড্রেজারসহ ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযান চলাচল বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, হালদা বেড়িবাঁধ প্রকল্পের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ৫ মার্চ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মুমিনুল হকের নেতৃত্বে আমরা হালদা নদীতে চারটি ড্রেজারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জব্দ করেছি। এ ছাড়া সবাইকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।’

উপজেলা মৎস্য অফিস এবং হালদা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, শুধু মা-মাছ নয়, হালদায় ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযানের অবাধ চলাচলে হুমকির মুখে রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ডলফিন। স্থানীয় ভাষায় এটি উতোম নামে বেশি পরিচিত।

সরকার ২০১০ সালে হালদার নাজিরহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। কিন্তু ড্রেজার, ইঞ্জিনচালিত ভারী নৌযান চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় হালদা নদীতে একের পর এক মৃত ডলফিন ভেসে উঠছে। বর্তমানে নদীতে ১৫০টির বেশি ডলফিন রয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়কালে হালদা নদীতে ১৬টি ডলফিন মারা গেছে।

(ঢাকাটাইমস/৯মার্চ/মোআ)