মধুপুর গড় ‘সংরক্ষিত বন’

উচ্ছেদ আতঙ্কে গারো-কোচরা

প্রকাশ | ০৯ মার্চ ২০১৯, ০৮:৩৪

রেজাউল করিম, টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়কে ‘সংরক্ষিত বন’ ঘোষণা করায় উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেন এ অঞ্চলের গারো ও কোচরা। পূর্বপুরুষের ভিটে ছাড়তে নারাজ ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক এই দুই গোষ্ঠীর সদস্যরা বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হতে চান। জমির খাজনা পরিশোধ করে বুঝে নিতে চান তাদের দখলকৃত ভূমি। কিন্তু না দিতে পারছেন খাজনা, না পারছেন জমির কাগজপত্র সংশোধন করতে।

পুরনো কাগজপত্রই তাদের একমাত্র সম্বল। স্থায়ী কাগজপত্র তৈরি করতে পারছেন না তারা। নিষেধাজ্ঞা থাকায় পাকা কোনো ঘরও তুলতে পারছেন না তাদের দখলকৃত ভূমিতে। কয়েক পুরুষ ধরে বসবাসকারী এসব মানুষ উচ্ছেদ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হলে কোথায় উঠবেন- এ নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছেন।

আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় অঞ্চল। বহু আগে থেকেই মধুপুর উপজেলার ১৩টি গ্রামে বসবাস করে আসছেন গারো ও কোচরা। বিশেষত স্মরণাতীত কাল থেকে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভূমিতে বসবাস করছেন গারো সম্প্রদায়ের লোকজন। তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ, অলঙ্কারাদি রয়েছে এবং নিজেদের সামাজিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় রক্ষণশীল তারা। গারোদের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী থেকে সহজেই আলাদা করা যায়।

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এক গেজেটের মাধ্যমে মধুপুর গড় এলাকার ৯ হাজার ১৪৫ একর জমিকে চূড়ান্তভাবে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করে। এই জমিগুলোর মধ্যেই গারো ও কোচদের গায়রা, জলই, টেলকি, সাধুপাড়া, জালাবাদা, কাকড়াগুনি, বেদুরিয়া, জয়নাগাছা, বন্দরিয়া, কেজাই, আমলীতলা পনামারি ও গাছাবাড়ি- এই ১৩টি গ্রাম পড়েছে। এসব গ্রামের ১ হাজার ৮৩টি গারো ও কোচ পরিবারের ৬ হাজার ৭৭ জনের বসতবাড়ি এবং তাদের আড়াই হাজার একর চাষাবাদের জমি রয়েছে।

সব মিলিয়ে এখানে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর লোকসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার ২০০ জন। এই বনে ‘ইকো ট্যুরিজম এলাকা’ ঘোষণার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বন বিভাগ। এটি বাস্তবায়িত হলে তাদের ভূমি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের পরিকল্পনা বাতিলসহ গারো ও কোচদের রেকর্ডভুক্ত জমি নিয়মিত খাজনা নেওয়া চালুর দাবিও জানান তারা।

অরণখোলা মৌজার প্রকাশ চন্দ্র জানান, ধর্মীয় রীতি অনুসারে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে চলে আসেন তিনি। তারপর থেকে যোগিন্দ্রনাথ বাহাদুর রাজার কাছে চাং দিয়ে ৩৫০ শতাংশ জমি ভোগদখল করছেন। কিন্তু এখন তিনি খাজনা দিতে পারছেন না।

অরণখোলা ইউনিয়ন পরিষদের ৪নং ওয়ার্ড সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যার প্রবীর নকরেক জানান, তার বাবা জ্ঞানেন্দ্র নকরেকের নামে রয়েছে ৮১ শতাংশ জমি। তারাও একই সমস্যায় ভুগছেন। নতুন ঘর তৈরি করতে পারছেন না। যেকোনো সময় উচ্ছেদ হওয়ার শঙ্কার কথা জানান তিনিও।

বৃদ্ধা অজয় এমরির দখলে রয়েছে ১ একর ২০ শতাংশ জমি। ভোগদখলে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে নতুন ঘর তুলতে পারছেন না তিনি, রয়েছেন মাটির ঘরে। ভূমি অফিস খাজনাও নিচ্ছে না। এ কারণে যেকোনো সময় উচ্ছেদ হতে পারেন বলে অজয়ের আশঙ্কা।

অজয় এমরি জানান, কয়েক পুরুষের আগের জমি সরকার তাদের ভোগদখলে দিলেও ১৯৮৪ সালে কোনো শুনানি ছাড়াই জমি ছেড়ে দেওয়ার প্রাথমিক নোটিশ আসে। এরপর ২০১৬ সালে চূড়ান্ত নোটিশ হয়। এখন তারা উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছে।

জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, 'বনকে কেন্দ্র করেই আমাদের জীবন। তারপরও আমাদের কেন ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হবে? আমরা এর সমাধান চাই। সম্পত্তির কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে নিয়মিত কর-খাজনার আওতায় আনতে সরকারের কাছে দাবি জানাই। তবে মধুপুর গড়কে ‘সংরক্ষিত বন’ ঘোষণা করা হলেও কবে নাগাদ বাস্তবায়িত হবে, তার সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেনি মধুপুর বন বিভাগ।

(ঢাকাটাইমস/০৯মার্চ/প্রতিবেদক/এআর)