ডাকসুর সমীকরণে ছাত্রী ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা

প্রকাশ | ১০ মার্চ ২০১৯, ১৯:৫২ | আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৯, ০৯:৫৩

ঢাবি প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

দীর্ঘ ২৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটছে কাল সোমবার। এদিন ভোট নেওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচনের। ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রতিটি হলে ভোটকেন্দ্র ও বুথ তৈরি করা হয়েছে।  হলে হলে পাঠানো হচ্ছে ব্যালট বাক্স ও পেপার।

রবিবার সকাল ৮টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত বিরতিহীন ভোট নেওয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে স্থাপিত ভোটকেন্দ্রে। নির্বাচনের প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শনিবার রাত ১২টায় শেষ হয়েছে। এখন অপেক্ষা ভোটের।

দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট হিসেবে খ্যাত ডাকসু নির্বাচনে কারা বিজয়ী হবে, জয়-পরাজয়ে কী কী বিষয় ভূমিকা রাখবে, এসব এখন আলোচনার বিষয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। মূলত দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল ক্যাম্পাসের বাইরে থাকায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের একাধিপত্য এ বিশ্বদ্যিালয়ে।

ডাকসু নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে এটি একটি ফ্যাক্টর হলেও, মনে করা হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা। তারা যেদিকে যাবে সেদিকেই ঝুঁকবে জয়ের পাল্লা। ফলে নির্বাচনের যেকোনো হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ছেলেদের ১৩ ও মেয়েদের ৫ হলে মোট ভোটার ৪৩ হাজার ২৫৬ জন। তাদের মধ্যে ছাত্র ২৬ হাজার ৯৪৪ যা মোট ভোটারের ৬২ দশমিক ২৯ শতাংশ, এবং ছাত্রী ১৬ হাজার ৩১২ জন, যা মোট ভোটারের ৩৭ দশমিক ৭১ শতাংশ।

ছেলেদের হলগুলোর গণরুমের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের প্রভাবের কারণে ছাত্রদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট পেতে পারে ক্ষমতাসীন দলের সংগঠনটি। তবে মেয়েদের হলগুলো এবং অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের একপেশে প্রভাব না থাকায় যেকোনো দিকে যেতে পারে তাদের সমর্থন। তারাই জয়-পরাজয়ে মূল নিয়ামক হবে।

ডাকসুতে ২৫টি ও প্রতিটি হল সংসদে ১৩টি করে পদ রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী প্রতিটি পদে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য একটি করে মোট ৩৮টি ভোট দিতে পারবেন।

এবার নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সংসদে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২১ প্রার্থী। ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর প্রতিনিধি হতে সবাই চেষ্টা করলেও মূল লড়াইটা হবে সম্মিলিত শিক্ষার্থী সংসদ মনোনীত প্রার্থী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের নূরুল হক নুরের মধ্যে। এর বাইরে আলোচনায় আছেন ছাত্রদলের মোস্তাফিজুর রহমান, প্রগতিশীল ছাত্রজোটের লিটন নন্দী ও স্বতন্ত্র জোটের অরণি সেমন্তি খান।

জিএস পদে ১২টি ছাত্রসংগঠনসহ স্বতন্ত্র মিলিয়ে প্রার্থী হয়েছেন ১৪ জন। তবে মূল লড়াই হবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, ছাত্রদলের আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক, কোটা সংস্কার আন্দোলনের রাশেদ খান, ছাত্র ফেডারেশনের ঢাবি শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজীর ও স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচন করা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র এ আর এম আসিফুর রহমানের মধ্যে।

ডাকসুর অন্যতম দায়িত্বপূর্ণ সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে লড়াইয়ে আছেন ১৩ জন। এই পদে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন প্রার্থী দিলেও ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন থাকছেন এগিয়ে। এ পদে তার সঙ্গে লড়াই হবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রার্থী মো. ফারুক হোসেন ও স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদের মো. আবু রায়হান খানের মধ্যে। এ ছাড়া অন্য প্রার্থীরা অপেক্ষাকৃত ক্যাম্পাসের অপরিচিত মুখ।

অন্য পদগুলোতে লড়াই হবে মূলত ছাত্রলীগ, কোটা সংস্কার ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। তবে এর মধ্যে কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ছাত্রদলের কানেতা ইয়া লামলাম সবার আলোচনায় রয়েছেন। তিনি ছাত্রদল মনোনীত একমাত্র নারী প্রার্থী।

নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে উপাচার্যকে স্মারকলিপি

এদিকে নির্বাচনের ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানো, পোলিং এজেন্ট দেয়ার সুযোগ, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স এবং নির্বাচনের দিন বিভিন্ন সড়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে প্রগতিশীল জোট ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। গতকাল বিকেলে তারা সবাই একসঙ্গে উপাচার্যের কার্যালয়ে যান। এ সময় কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটে তাদের বাধা দেয়া হয়। প্রতিবাদে প্রার্থীরা সেখানেই অবস্থান নেন। এ সময় নেতাকর্মীরা ‘ছলচাতুরি হেলমেটে, জবাব দিবে ব্যালটে’, ‘হৈ হৈ রৈ রৈ, হর্তাকর্তা গেলি কই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। পরে প্রার্থীদের মধ্যে কয়েকজনকে উপাচার্যের কার্যালয়ে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়।

এ সময় প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের প্যানেলে ডাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী লিটন নন্দী, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেলে ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুর, স্বতন্ত্র সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান, স্বতন্ত্র জোটের ভিপি প্রার্থী অরণী সেমন্তী খান ও ছাত্র ফেডারেশনের জিএস প্রার্থী উম্মে হাবিবা বেনজীর উপাচার্য কার্যালয়ে গিয়ে উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেন।

স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতার মধ্যে সহজেই অর্জনযোগ্য কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করা হলে ১১ তারিখের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব বলে মনে করি। এর মধ্যে আছে, আরও ৪ ঘণ্টা ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানো, কেবল পোলিং বুথের ভেতর ছাড়া নির্বাচনী এলাকা ও ভোটকেন্দ্রের তথ্য সংগ্রহে সব ধরনের গণমাধ্যমের অবাধ সুযোগ তৈরি, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার ও পোলিং এজেন্ট নিয়োগের অনুমতি, নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ও ভোটারদের নিরাপত্তা বিধানে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ, ভোট গ্রহণের দিন সকালবেলা সব রুটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের সংখ্যা বাড়ানো।’

স্মারকলিপি দিয়ে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের প্রার্থী লিটন নন্দী বলেন, ‘আমাদের দাবি উপেক্ষা করে নির্বাচন করছে প্রশাসন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনিয়ম হলে প্রশাসনকে আমরা ছেড়ে কথা বলব না। গঠনতন্ত্রে পোলিং এজেন্টের কথা রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ প্রভোস্ট পোলিং এজেন্ট রাখার বিপক্ষে মত দিয়েছেন। আমরা মনে করি, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এই ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।’

রাতেই যাচ্ছে ভোটের ব্যালট

ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট ভোটের দিন সকালে নয়,  আজ সন্ধ্যা সাতটার দিকে হলে হলে পৌঁছানো হয় ব্যালট পেপার। রবিবার নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক এস এম মাহফুজুরর রহমান এই তথ্য জানিয়েছেন। এ বিষয়ে মাস্টার দা সূর্যসেন হলের চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন বলেন, ভোটকেন্দ্রে অনেক কাজ। বিষয়গুলো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সামগ্রিক বিষয় চিন্তা করে রাতেই ব্যালট বাক্স-পেপার পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।

এর আগে নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের দিন সকালে ব্যালট বাক্স পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা। সে সময় তিনি জানিয়েছিলেন, ‘সবার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যালট পেপার সকালে পাঠানোর প্রস্তাব আমরা গ্রহণ করলাম।’ কিন্তু হঠাৎ করেই আজ এই সিদ্ধান্ত জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেক প্রার্থী।

তারা বলছেন, শুরু থেকেই ছাত্রলীগ নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাদে ছাত্রদল, বাম ছাত্রসংগঠন, কোটা সংস্কার প্যানেলগুলো হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করে আসছে। মূলত হলে কেন্দ্র হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার আশঙ্কা করছিলেন তারা। সেই প্রেক্ষাপটেই ব্যালট পেপার ভোটের সকালে পাঠানোর প্রস্তাব দেয়া হয় এবং প্রশাসন তা মেনে নেয়। কিন্তু পূর্বঘোষণা ছাড়াই তা পরিবর্তন হচ্ছে।

শেষ মুহূর্তে ছাত্রলীগের আচরণবিধি লঙ্ঘন

রবিবার সকাল আটটার পর নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ থাকলেও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রচারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ডাকসুর এজিএস প্রার্থী ও ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনের প্রচারণা চালানো হয়। এ সময় ছাত্রলীগ নেতারা হলটির রুমে রুমে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করেন।

দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হলে ডাকসুর জিএস প্রার্থী ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর পক্ষে প্রচারণা চালান প্রথম বর্ষের তিনজন শিক্ষার্থী। তারা রুমে রুমে গিয়ে রাব্বানীর লিফলেট বিতরণ করেন বলে হলটির একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী নিশ্চিত করেন।

(ঢাকাটাইমস/১০মার্চ/মোআ)