এই নুর সেই নুর: এবার হুঁশে আসবে ছাত্রলীগ?

প্রকাশ | ১৩ মার্চ ২০১৯, ১৭:৩৩ | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৯, ১৮:৩০

আলম রায়হান

ডাকসুর ভিপি হিসেবে নুরুল হকের বিজয় অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। কথিত অভিযোগ হচ্ছে, নুর ‘শিবির’। তো ডাকসুতে ‘শিবির কর্মী’ নুরুল হক ভিপি নির্বাচিত হলো কীভাবে? এটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। নুরুর চৌদ্দপুরুষ উদ্ধারে যারা ব্যস্ত তাদের এ বিষয়টি ভাবা উচিত। তার পেছনে তো কোনো সুসংগঠিত ছাত্র সংগঠন ছিল না। ক্ষমতার, প্রশাসনের আশির্বাদও তার কপালি কখনো জোটেনি। বরং কোটা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তাকে ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরে বারবার নির্যাতিত হতে হয়েছে। অসম্ভব বৈরিতা মোকাবেলা করেই ভোটের লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন তিনি। তবু শিক্ষার্থীরা তাকে ভোট দিলো। এরপর তাকে শিবির বানানোর অপচেষ্টা কতটা শোভন!।

নুরুল হককে যে ১১ হাজার শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছেন তাদের সবাইকে শিবির বানানোর চেষ্টা করলে আখেরে কার লাভ- তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। গত ১০ বছর ধরে তো ক্যাম্পাসে সরকারসমর্থিত ছাত্রলীগ ছাড়া তো আর কোনো সংগঠনের কোনো তৎপরতা নেই। তা হলে এতো শিবির কোত্থেকে এলো? তর্কের প্রয়োজনে ধরে নেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিপিলিকার মতো শিবির জন্মেছে। তা হলে ছাত্রলীগ কী করেছে? মাথার উপর ক্ষমতার ছায়া থাকা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কার্যত একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো না কেন? কেন গোপন বিচারের সুযোগ এতোগুলো শিক্ষার্থী নুরুল হককে বেছে নিলো? শিক্ষার্থীদের আস্থা-অনাস্থার বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করতে হবে নানান ঐতিহ্য ও গৌরবের ধারক ছাত্রলীগকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ভোটে ভিপি নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও নুরুল হককে মেনে নেয়নি ছাত্রলীগ। প্রতিবাদের নামে ১২ মার্চ ক্যাম্পাসে দিনভর অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নবনির্বাচিত ডাকসু ভিপিকে গরুপেটা করে ক্যাম্পাস ছাড়া করেছে ছাত্রলীগের কতিপয় গুণধর কর্মী। কিন্তু গুণধররা তখন বিবেচনায় নেয়নি, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যাশা ধারণ করে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগের একদল কর্মী চরম নির্যাতন করেও এই নুরুল হককে দমাতে পারেনি। সেই নির্যাতন এমন চরমে পৌঁছেছিল যে একবার শিক্ষকের পা জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতি করতে হয়েছে নুরুল হককে। শ্রদ্ধেয়দের তালিকায় থাকা শিক্ষক সেদিন তাকে রক্ষা করার কোনো উদ্যোগ নেননি।

এরপরও নুর রণে ভঙ্গ দেননি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা সঙ্গে থেকেছেন পুরো মাত্রায়। সেই নুর এবার ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শোভনের ক্লিন ইমেজ এবং আরও অনেক নানান বৈরিতাকে অতিক্রম করে। কিন্তু এসব বিবেচনায় না নিয়ে ছাত্রলীগের একটি অংশ অতিমাত্রায় বিপ্লবী হবার অস্বস্তিকর কাণ্ড ঘটিয়ে বসলো। অবশ্য দিনভর এই অস্বস্তির অবসান ঘটে শোভনের নায়কোচিত উদার ভূমিকার মাধ্যমে। হানাহানি আর গালাগালির ধারার অবসান হয় কোলাকুলির মধ্যদিয়ে। আর এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই যে, প্রত্যাশিত এটি হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় ইচ্ছায়।

শোভন সম্পর্কে কিছুটা জানি। কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী সদরে তার বাড়ি। শোভনরা তিনপ্রজন্ম আওয়ামী লীগ করেন। এলাকায় তাদের পরিবারের কোনো বদনাম নেই। একই ইমেজ তার বিশ্ববিদ্যারয় ক্যাম্পাসেও। এরপরও সে নুরুল হকের সাথে পরাজিত হলো। বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন। ছাত্রলীগের সভাপতি শোভনকে অভিনন্দন জানাই। কারণ, যোগ্য ছাত্রনেতার কাজটিই করেছেন তিনি। ভোটে হেরে গিয়েও তিনি বিজয়ী ভিপিকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন, সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। শোভন আর নুরু জড়িয়ে ধরার ছবিটি অনেক বার্তা দেয়, অনেক কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী, সারা দেশের মানুষ এই ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন হচ্ছে, এবার হুঁশে আসবে তো ছাত্রলীগ?

ডাকসুর ভিপি হিসেবে নুরুল হকের জয়লাভকে যারা মেনে নিতে চান না তাদের অভিযোগ হচ্ছে, নুরু শিবির। বায়বীয় এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ডাকসুতে ‘শিবির কর্মী’নুর ভিপি হয়ে গেল কীভাবে? তার পেছনে কোনো ছাত্র সংগঠন ছিল না। ক্ষমতার, প্রশাসনের আশির্বাদও ছিল না তার ধারেকাছেও। নিদারুণ বৈরিতা মোকাবেলা করেই সে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছে এবং শিক্ষার্থীরা তাকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছেন। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তো ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না যে, একজন শিবির কর্মীকে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত করবে! আসলে যারা এ অভিযোগ তুলছেন তাদের মেধা নিয়ে সংশয় সৃষ্টির যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তা না হলে যে ১১ হাজার শিক্ষার্থী নুরুকে ভোট দিয়েছে তাদের সবাইকে প্রকারন্তরে শিবির বলতেন না।

গত এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্যাম্পাসে তো সরকার সমর্থিত ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোনো সংগঠনের কার্যত কোনো তৎপরতা কারো চোখে পড়েনি। সেখানে  তো শিবির এলো কোথা থেকে? মাথার উপর ক্ষমতার কেবল ছাতা নয়, একবারে ছাদ থাকা সত্ত্বেও  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কেন নুরু নামের এই ছোটখাটো ছেলেটিকে সামলাতে পারলো না! ভোটে হেরে পেশি ও চাপায় জয়ী হবার চেষ্টা করাটা মোটেই কাজের কথা নয়। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে কথায় কথায় 'শিবির-শিবির' জিকির না তুলে ছাত্রলীগকে নিজেদের দিকে তাকাতে হবে। আর যদি পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই 'রাজাকার' হয়ে গিয়ে থাকে, ‘শিবির’ আস্তানায় পরিণত হয়ে থাকে, তা হলে সেটার দায় কার তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। ছাত্রলীগকে নানান হিসেব মিলাতে হবে। নুরুকে গালি গালাজ করে, অসম্মান করে কোনো লাভ হবে না। কারণ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থীরা তাকেই নেতা মেনেছে, আস্থা রেখেছে তার উপরই ।

নুর কি কোনো দিন শিবিরের মিছিলে গেছেন, যাননি। তিনি শিবির ছিলেন না, তাকে জোর করে শিবির বানালে বেশি ক্ষতি হয়। একজন সৎ ছেলে কি ডাকসু ভিপি হতে পারেন না? এখন একেবারে মাটি থেকে উঠে এসেছে, নির্যাতনের আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়েছে। তিনি মার খেতে ভয় পান না, দাবি থেকে পিছু হটেন না। কোটা আন্দোলন করে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর মনে স্থান করে নিয়েছিলেন নুর, এই জয়মাল্য তার পুরস্কার।

মোদ্দাকথা হচ্ছে, কথায় কথায় শিবির শিবির জিকির না তুলে ছাত্রলীগকে নিজেদের দিকে তাকাতে হবে। অন্যকে জামাত-শিবির-রাজাকার বলে নিজের দুর্গন্ধ আড়াল করা যায় না। শোভনের মতো সুসংগঠিত সংগঠনের মার্জিত নেতাকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষার্থীরা কেন নুরুল হককে ভোট দেয় তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। আদর্শিকভাবে, সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগ কতদূর কী করেছে- তার হিসাব মেলানও এখন জরুরি। এসব না করে কেবল নুরুল হককে গালিগালাজ করে, অসম্মান করে কোনো লাভ নেই। শিক্ষার্থীরা তাকেই নেতা মেনেছে, তার উপরই আস্থা রেখেছে।

সকলেরই স্মরণে আছে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় এই নুরুল হককে কুকুরের মতো পেটানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পা জড়িয়ে ধরে বাঁচার আর্তনাদের ছবি দেখলে এখনো অনেকের চোখ ভিজে আসে। মানুষকে মানুষ এভাবে মারতে পারে! এখানেই শেষ নয়। তাকে জেলে দেয়া হয়েছে। এমনকি বেসরকারি হাসপাতালে ও প্রকাশ্যে চিকিৎসা দেয়া হয়নি। পরিবারকে অপমান করা হয়েছে। সারা জীবন সরকারি চাকরি না দেয়ার হুমকি দিয়েছে অতি উৎসাহী গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু নুরু দমেনি। বরং গুরুর মতোই দৃঢ় থেকে শুরু থেকেই। মাটি কামড়ে থেকেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রথ্যাশার সঙ্গে। বৈরী স্রোতের বিপরীতে টিকে ছিল সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। বাঘের খাচায় থেকে বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করার সাহস দেখিয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর পুরস্কার দিলো ভিপি নির্বাচিত করে।  নুরুল হক শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাকে অসম্মান করলে শিক্ষার্থীদেরই অসম্মান করা হয়- শোভন সেটা বুঝতে পেরেছেন বলে আমার ধারণা। আশা করি তার নেতৃত্বে থাকা ছাত্রলীগের কর্মীরাও সেটা বুঝবেন। নুরু-শোভনদের নেতৃত্বে ছাত্ররাজনীতি গ্রহণযোগ্য এবং ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসবে। এমনটাই ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা।

আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক