ভুয়া প্রকৌশলীর অভিনব প্রতারণা

প্রকাশ | ১৫ মার্চ ২০১৯, ১০:৪৫ | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৯, ১০:৫৫

ব্যুরো প্রধান, রাজশাহী

মাধ্যমিকের গণ্ডিই পার হতে পারেননি। তবে সোহান মাহমুদ ওরফে শুভ মৃধা নিজেকে একজন প্রকৌশলী হিসেবেই পরিচয় দেন। এসএসসি থেকে বিএসসি পর্যন্ত সব জাল সনদ দিয়ে চাকরি নেন বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। বেতনও পান ভাল। আর তার নেশা শুধু বিয়ে করা।

বিয়ে পাগল এই ভুয়া প্রকৌশলীর বাড়ি নাটোরের সিংড়া উপজেলার বাকুন্দা গ্রামে। বাবার নাম আবদুল মজিদ মৃধা। তিনি একজন বর্গাচাষি। তবে শুভ তার বাবার পরিচয় দেন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল হিসেবে। এসব মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে প্রতারণা করে শুভ এ পর্যন্ত তিনটি বিয়ে করেছেন।

সর্বশেষ রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার একজন মেডিকেল ছাত্রীকে ফাঁদে ফেলেন শুভ। গত ২২ ফেব্রুয়ারি নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে মহাধুমধামে তাদের বিয়ে হয়। খবর পেয়ে পরদিন ঢাকা থেকে তিন বছরের সন্তানসহ ছুটে আসেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। এরপরই শুভর একের পর এক প্রতারণার বিষয়টি জানাজানি হয়। অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে তার প্রতারণার সব চমকপ্রদ তথ্য।

নগরীর রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, শুভ একটা প্রতারক। তার ব্যাপারে থানায় একটা সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। প্রতারিত পরিবারটি মামলা করলে নেয়া হবে। আর শুভর সার্টিফিকেটগুলোও জাল। সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন স্থানে চাকরি করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চাইলেই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুভর বাবার অভাব-অনটনের সংসার। তাই শুভর পড়াশোনা হয়নি। জীবিকার তাগিদে সিংড়া উপজেলা সদরে মুঠোফোন রিচার্জের ব্যবসা করতেন শুভ। কিছু দিন গাড়িচালক হিসেবেও কাজ করেন। এরপরই রাতারাতি হয়ে ওঠেন প্রকৌশলী! শিক্ষা সনদের জাল ফটোকপি দিয়ে চাকরি নেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। আর এ জন্য নিজেকে একজন প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় দেন সব সময়।

শুভর ভোটার তথ্য ফরমে (ভোটার নম্বর- ৬৯০৮২০০৩৩) দেয়া হয়েছে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক। তবে তিনি মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হননি। অথচ শুভ রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা এবং ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স (ইউআইটিএস) থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি পাশের জাল সনদ দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। চাকরি নেয়ার সময় শিক্ষা সনদের যেসব ফটোকপি শুভ দিয়েছেন, তার সবই জাল। শিক্ষাবোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

শুভ যেসব সনদ ব্যবহার করেন তার মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসির রোল নম্বর ১০৮৩১২। পাসের বছর ২০০৪ সাল। ডিপ্লোমার সনদ বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের। রোল নম্বর ৫১০৩১৩। পাসের বছর ২০০৮। আর ইউআইটিএসের যে সনদ দেয়া হয় তার সিরিয়াল নম্বর ৩০৫২২২। ২০১৩ সালের আগস্টে ইস্যু হিসেবে দেখানো এই সনদে শিক্ষার্থীর আইডি নম্বর- ১০৪২০২৭১।

শুভর এসএসসির রোল নম্বর দিয়ে অনলাইনে শিক্ষাবোর্ডের আর্কাইভে কোনো শিক্ষার্থীরই ফলাফল পাওয়া যায়নি। রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর আনোয়ারুল হক প্রামাণিক বলেন, অনলাইন আর্কাইভে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ফলাফল দেয়া আছে। সেখানে ফলাফল না পাওয়া গেলে বুঝতে হবে সনদপত্রটি জাল।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অনলাইনেও শুভর সনদের রোল নম্বর দিয়ে ফলাফল পাওয়া যায়নি। বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. প্রকৌশলী সুশীল কুমার পালও বলেছেন, শুভর ওই সনদটি জাল। শিক্ষার্থীর আইডি নম্বর নিয়ে খুঁজে দেখে একই কথা জানিয়েছেন ইউআইটিএআইয়ের সিনিয়র সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জেসমিন সুলতানা। তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে সনদটি জাল।

শুভ ‘প্রকৌশলী’ হয়ে ওঠার আগে ২০০৯ সালে সিংড়া পৌরসভার মাদারিপুর মহল্লার এক ভ্যানচালকের মেয়েকে বিয়ে করেন। শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসার সময় ওই এলাকার এক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী তার টার্গেটে পড়েন। ২০১৪ সালে শুভ ওই ছাত্রীর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কথাবার্তা শুরু করেন। গোপন রাখেন বিয়ের কথা। শুভ তখন একজন প্রকৌশলী হিসেবেই কুষ্টিয়ায় একটা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রেমের ফাঁদে ফেলে ওই বছরের ১২ নভেম্বর শুভ সেই ছাত্রীকে আদালতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। এরপর আগের বিয়ের কথা জানিয়ে সেদিনই প্রথম স্ত্রীকে গর্ভবতী অবস্থায় তালাক দেন। শুভর তালাকপ্রাপ্ত প্রথম স্ত্রীর এখন পাঁচ বছরের একটা ছেলে আছে।

দ্বিতীয় স্ত্রী জানান, প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেয়ায় তিনি সংসার শুরু করেন। তারও একটা ছেলে সন্তান হয়। পরবর্তীতে তার শিক্ষা সনদসহ প্রতারণার নানা বিষয় তিনি বুঝতে পারেন। কিন্তু নিজের সংসারের কথা ভেবে সবকিছু সহ্য করেন। তারপরেও শুভ অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। সর্বশেষ রাজশাহী নগরীর একজন মেডিকেল ছাত্রীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তৃতীয় বিয়ে করেন। তবে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে তৃতীয় স্ত্রী বিয়ের পরদিনই শুভকে তালাক দিয়েছেন।

তিনি জানান, গত বছর শুভ ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। বেতন পেতেন প্রায় ৫০ হাজার টাকা। তখন তিনি স্বামীর সঙ্গেই ঢাকায় থাকতেন। গত বছরের নভেম্বরে শুভ সেই চাকরি ছেড়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের একটি প্রকল্পে প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। এরপর শুভ রাজশাহীতে থাকতে শুরু করেন। তিনি রাজশাহী আসতে চাইলেও শুভ তাকে বলতেন, কিছু দিন পরই এই চাকরি ছেড়ে তিনি ঢাকায় আসবেন। এভাবে তাকে রাজশাহী না এনে তৃতীয় বিয়ের ফাঁদ পাতেন।

তিনি আরও জানান, তৃতীয় বিয়ের পরদিনই শুভ তালাকপ্রাপ্ত হলে নিজের সন্তানের কথা ভেবে তিনি মেনে নেন। রাজশাহী থেকে স্বামীকে বাড়ি নিয়ে যান। সাতদিন শুভ শ্বশুরবাড়িতেই থাকেন। এরপর ব্যাংক ঋণের কথা বলে শুভ তার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য  শ্বশুরের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। ড্রয়ার থেকে নেন আরও ৯৫ হাজার টাকা। সঙ্গে একজোড়া বালা নিয়ে ব্যাংকে ঋণ পরিশোধের কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আর ফেরেননি।

শুভর দ্বিতীয় স্ত্রী বলেন, এমন প্রতারণার ফাঁদে যেন আর কেউ না পড়ে। তার ব্যাপারে তিনি আইনের আশ্রয় নেবেন।

শুভর তৃতীয় স্ত্রীর বাবা বলেন, আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। আমার মেয়েটাকে শুভ প্রেমের ফাঁদে ফেলেছিল। মেয়েটা বড় হয়েছে বলে তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলাম। শুভ বলেছিল, তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল  তবে সম্পর্ক নেই। ঠিকানা দেয়া হয়েছিল নাটোর সদরের। ভেবেছিলাম, মেয়ে ডাক্তার হচ্ছে, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। তারা ভাল থাকবে। কিন্তু সবই মিথ্যা। ও একটা বড় প্রতারক। আমরা তার ব্যাপারে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি।

শুভর বাবা আবদুল মজিদ মৃধা দাবি করেন, তার ছেলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। তবে নিজে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নয়, একজন সাধারণ কৃষক বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, সব বিয়েই শুভ একা একা করেছে। ছেলের তৃতীয় বিয়ের কথা তাকে কেউ জানায়নি বলেও জানান মজিদ মৃধা।

সিংড়ার ইটালী ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মকবুল হোসেন বলেন, শুভ মৃধার ডাকনাম ফারুক। তার বাপে একজন কৃষক। নিজের জমিটমি নাই। কামলা বেচে।

শুভ সম্পর্কে বলেন, ‘শুভ এইট পাস। আরেকজনের সার্টিফিকেট দিয়ে নাকি চাকরি করে। এখন আয়ে পাস দিল না বিয়ে পাস দিল বলতি পারব না। কি চাকরি করে সেটাও আমি জানি না।’

মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে সোহান মাহমুদ ওরফে শুভ মৃধা ওরফে ফারুক বলেন, ‘তিনটা বিয়ে করেছি, সবগুলোই অ্যাকসিডেন্ট।’ শিক্ষা সনদ জালিয়াতি করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সবাই কেন সার্টিফিকেট জাল বলছে তা বুঝতে পারছি না। আমি পাঁচ-ছয় মিনিট পর আপনাকে ফোন করছি।’ তবে শুভ আর ফোন করেননি।

পরবর্তীতে আবার ফোন করা হলে শুভ বলেন, ‘সার্টিফিকেট জাল করি আর যাই করি, যেখান থেকে পারি সেখান থেকে আয় করে স্ত্রীকে খাইয়েছি। এখন আমার তৃতীয় বিয়েকে কেন্দ্র করে এসব কথা বাইরে বলে বেড়াচ্ছে।’                                                                                                                                                            

ঢাকাটাইমস/১৫মার্চ/ওআর