কতটা জোয়ার তুলতে পারবেন প্রিয়াঙ্কা?

প্রকাশ | ১৯ মার্চ ২০১৯, ১৯:৫২

ঢাকাটাইমস ডেস্ক

ভারতের নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই বিজেপিবিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভোটে লড়ার প্রচেষ্টা শুরু করেছিল। কলকাতা আর দিল্লিতে বিরোধীদের কয়েকটি সভা সমাবেশ যেমন হয়েছে, তেমনই বিজেপি-র বিরুদ্ধে ভোটে লড়ার কৌশল ঠিক করতে বৈঠকে বসেছেন বিরোধী দলীয় নেতা নেত্রীরা।

কিন্তু রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে সেই ঐক্য প্রচেষ্টায় বাধা আসছে আঞ্চলিক দলগুলোর দিক থেকে।

রাজনৈতিকভাবে আর আসন সংখ্যার নিরিখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তরপ্রদেশে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদী পার্টি (এসপি) আর বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) অনেক আগেই যৌথভাবে ভোটে লড়ার কথা ঘোষণা করে দিলেও সেই সমঝোতায় কংগ্রেসকে তারা রাখেনি।

শুধু গান্ধী-নেহেরু পরিবারের চিরাচরিত আসন বলে পরিচিত আমেতি আর রায়বেরেলি - এই দুটি আসনে এসপি-বিএসপি লড়বে না বলে জানিয়েছিল। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীও ঘোষণা করেছিলেন যে তার দল একাই লড়বে।

আবার বিহারের ক্ষেত্রে লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল বা আরজেডির সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনায় কংগ্রেস চেয়েছিল ১৫টি আসন। কিন্তু আরজেডি কংগ্রেসকে আটটির বেশি আসন ছাড়তে রাজি নয়।

রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে অন্যান্য দলগুলোর আসন সমঝোতা সর্বশেষ ধাক্কা খায় পশ্চিমবঙ্গে।

বামফ্রন্টের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা চলছিল কংগ্রেস নেতাদের।  কিন্তু কয়েকটি আসন নিয়ে মতান্তরের জেরে সেই প্রক্রিয়া সোমবার একরকম শেষ হয়ে গেল বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

আগেরবারের জেতা আসনসহ ১৭টি আসনে বামফ্রন্ট আগেই প্রার্থী ঘোষণা করেছিল। বামফ্রন্ট যে কেন্দ্রগুলোতে প্রার্থী দিয়েছিল, তার অনেকগুলোতেই সোমবার গভীর রাতে প্রার্থী দিয়ে দেয় কংগ্রেস।

আজ মঙ্গলবার বামফ্রন্টও চারটি আসন ছেড়ে বাকি সব আসনে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

যদিও ঝাড়খণ্ড, তামিলনাড়ু, কর্নাটক আর মহারাষ্ট্রের মতো অন্য কিছু রাজ্যে কংগ্রেস আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে জোট বাঁধতে সমর্থ হয়েছে। আসন ভাগ নিয়ে কিছু দর কষাকষি এখনও চলছে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে কেন বিজেপি বিরোধী দলগুলো জোট দানা বাঁধল না?

জানতে চেয়েছিলাম প্রবীণ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গৌতম লাহিড়ীর কাছে।

‘কিছুদিন আগে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান আর ছত্তিসগড়ের নির্বাচনে জয়ের পরে কংগ্রেস দল আর তার কর্মীরা এখন অনেকটা উজ্জীবিত। এর ফলে রাজ্যভিত্তিক দলগুলো - যাদের ভোট-ব্যাংকের সঙ্গে কংগ্রেস ভোট-ব্যাংকে কিছুটা সাদৃশ্য আছে, তারা বোধহয় আশঙ্কা করছে যে কংগ্রেস যদি লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফল করে ফিরে আসতে পারে, তাহলে ওই রাজ্যভিত্তিক দলগুলি দুর্বল হয়ে পড়বে’, বলছিলেন লাহিড়ী।

‘সেক্ষেত্রে ভোটের পরে ওই আঞ্চলিক দলগুলির দরকষাকষির ক্ষমতাও দুর্বল হবে। এই ভয় থেকেই কংগ্রেসকে বেশি আসন ছাড়তে রাজি হচ্ছে না।’

‘এই সমস্যাটা পশ্চিম বা দক্ষিণে নেই, উত্তর প্রদেশ, বিহার আর পশ্চিমবঙ্গেই এটা দেখা যাচ্ছে,’ বলছিলেন তিনি।

আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রজত রায় বলছিলেন, বিরোধীদের মহাজোট প্রক্রিয়াটা যখন শুরু হয়েছিল, তখন সব দলই কংগ্রেসকে কিছুটা দুর্বল ভাবছিল। খুব বেশি হলে ১০০টির কাছাকাছি হয়তো আসন তারা পাবে, এমনটাই মনে হচ্ছিল। আর সে কারণে আঞ্চলিক দলগুলোর নেতা নেত্রীদের মধ্যে একটা প্রধানমন্ত্রীত্বের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল।

‘কিন্তু হঠাৎ করেই প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে রাজনীতিতে নিয়ে এসে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব দিয়ে খেলাটা বদলে দিয়েছেন রাহুল গান্ধী।’

‘প্রিয়াঙ্কা আসার পরেই কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে যে একটা আবেগ তৈরি হয়েছে। আর সেই আবেগকে কাজে লাগিয়েই কংগ্রেস অনেকটা জোর গলায় আসন ভাগের ব্যাপারে দরকষাকষিতে নেমেছে।’

‘আসন সংখ্যা নিয়ে তাদের এই জোরদার দাবি দেখেই অনেক আঞ্চলিক দল কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে চাইছে না,’ বলছিলেন মি. রায়।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর রাজনীতিতে আসা এবং তাকে ঘিরে আবেগ তৈরি হওয়া কি সত্যিই কংগ্রেসকে বাড়তি ভোট দেবে, যে বিশ্বাসে কংগ্রেস জোর গলায় আঞ্চলিক দলগুলোর কাছ থেকে বাড়তি আসন দাবি করছে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘এক্ষেত্রে দুটো বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত একটা বিশালসংখ্যক ভোটার রয়েছেন যাদের বয়স ৪০ থেকে ৫০ এর মধ্যে। এই বয়সের ভোটাররা টিভি দেখতে যখন শুরু করেছিলেন, তখনই ১৯৮৪ সালে শিশু প্রিয়াঙ্কা আর রাহুলকে তারা দেখেন ঠাকুমার মরদেহের পাশে, চিতার সামনে। এই ছবিটা এই বয়সের ভোটারদের মনে গেঁথে আছে। তাদের একটা আবেগ প্রিয়াঙ্কার পক্ষে কাজ করতে পারে।’

‘আবার আট কোটিরও বেশি নতুন ভোটার আছেন, যারা এবারই প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ভোট দেবেন ১৯৯৭ থেকে ২০০১ -এর মধ্যে জন্ম নেয়া। এই বয়সের ভোটারদের মধ্যে একেবারে আনকোরা নতুন কিছু পাওয়ার একটা বাসনা থাকে। প্রিয়াঙ্কার হাঁটা চলা, কথা বলা - সবই কিন্তু তাদের কাছে একদম নতুন, ফ্রেশ। এদের একটা সমর্থনও হয়তো কংগ্রেস পাবে।’ জানালেন মি. ভট্টাচার্য।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ভোটের রাজনীতিতে আসা, কংগ্রেস দলের উজ্জীবিত হয়ে ওঠা আর আঞ্চলিক দলগুলির আশঙ্কা তৈরি হওয়া যে কংগ্রেস ভালো ফল করলে তারা নিজেরা দুর্বল হয়ে পড়বে - এই সবের মধ্যেও একটা বিষয়ে বিশ্লেষকরা একমত।

জোট না হওয়ার কারণে এই রাজ্যগুলিতে বিজেপি কিছুটা বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাবে।

রজত রায় বলছিলেন, ‘বিজেপির সুবিধা হয়েছে দু'দিক দিয়ে। পুলওয়ামার জঙ্গি হামলা আর তার পরবর্তীতে সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলেও সেটা তাদের কিছুটা যেমন অ্যাডভান্টেজ দেবে, আবার তেমনই আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে কংগ্রেসের জোট না হওয়ায় বিজেপি-বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাবে - সেই সুবিধাটাও পাবে বিজেপি।’

উত্তর প্রদেশে ভোট হয় জাতিগত সমীকরণ দিয়ে। আর সেখানে যাদব গোষ্ঠীর ভোট কংগ্রেস কখনই পেত না।

‘কিন্তু দলিত আর মুসলিম ভোট বিরোধীদের মধ্যে ভাগ হয়ে গেলে ওই রাজ্যে বিজেপি তো সুবিধা পাবেই কিছুটা। আর বিহারের ক্ষেত্রে কংগ্রেস দীর্ঘকাল ধরেই প্রান্তিক শক্তি। তাই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না হলে লালু যাদবের বিশেষ কিছু ক্ষতির সম্ভাবনা আমি দেখি না।’

‘আর পশ্চিমবঙ্গে লড়াইটা যদি চতুর্মুখী হয়, তাহলে বিজেপির থেকেও বেশি লাভ হবে তৃণমূল কংগ্রেসের,’ বলছিলেন গৌতম লাহিড়ী। -বিবিসি বাংলা

(ঢাকাটাইমস/১৯মার্চ/জেবি)