অন্যের কাছে এভাবে নিজের অবমূল্যায়ন কেউ করে!

খলিল আহমেদ
 | প্রকাশিত : ২৯ মার্চ ২০১৯, ১৯:০৬

২৮ মার্চ ২০১৯ তারিখে একটি সেমিনারে রিসোর্স পারসন হিসেবে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেমিনারটি পল্টনে এনএসসি ভবনে এ বিআইপিডি, বাংলাদেশ ইন্স্যরেন্স একাডেমি এবং ভারতীয় বীমা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (আইআইআই) সেমিনারের আয়োজন করেছিল। সৌভাগ্য বলছি এজন্য আমি সেমিনারে না গেলে বুঝতে পারতাম না যে, বিজ্ঞ ও বয়স্ক বাংলাদেশি (যাদের বক্তব্য আগে শ্রবণ করার অভিজ্ঞতা আমার নেই) তারা বিদেশিদের সামনে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে কত ছোট করতে পারে।

আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে, সেমিনার পেপার উপস্থাপনের সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মহোদয় এবং অতিরিক্ত সচিব মহোদয় উপস্থিত ছিলেন না। সচিব মহোদয় এবং অতিরিক্ত সচিব মহোদয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়ে সরকারি ব্যস্ততার কারণে সেমিনার কক্ষ ত্যাগ করেন। সেমিনারের প্রতিপাদ্য ছিল কীভাবে বীমাশিল্পের ইমেজ বাড়ানো যায়। পৃথিবী বিখ্যাত ভারতের বীমা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের দুজন ফ্যাকাল্টি মেম্বার ড. থমাস এবং জনাব প্রদীপ সরকার উপস্থিত ছিলেন। তাদের সামনে যেভাবে আমাদের বীমাশিল্পকে তুলে ধরা হয়েছে তাতে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। আরও কষ্ট পেয়েছি আমার দেশের কোনো কোনো বীমা বিশেষজ্ঞ কোনো আপডেট তথ্য জানেন না। আমি কিছু পজিটিভ দিক তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।

যা হোক, ভারতের দুই বিশেষজ্ঞকে আমাদের বীমাশিল্পের ওপর সেমিনারের আগের দিন কিছু ধারণা দিতে পেরেছি বিধায় তারা তাদের বক্তব্যে আমাদের দেশের বীমাশিল্পের ভালো মূল্যায়ন করেছেন এবং কিছু ভালো পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের পরামর্শ হলো বাংলাদেশও এগুলো অনুসরণ করতে পারে:

(ক) ব্যাংক অ্যাস্যুরেন্স পদ্ধতি চালু করলে বীমাশিল্পের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভারতের ব্যাংক এজেন্টকে বীমা গ্রাহকের যাবতীয় বীমা সেবা প্রদানের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে।

(খ) ভারতে কর্পোরেট এজেন্ট বিধিমালার মাধ্যমে পঞ্চায়েতসহ প্রায় দশ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বীমা এজেন্ট হিসেবে কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

(গ) ভারতে সার্ভেয়ারদের নিয়ন্ত্রণ করতে এপেক্স বডি করা হয়েছে এবং এটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার, বীমাকারীর প্রতিনিধি এবং সার্ভেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত হয়। সার্ভেয়ারের জন্য সম্প্রতি আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে যার ফলে প্রত্যেক সার্ভেয়ার গ্রাহককে সার্ভে কপি প্রদান করতে বাধ্য। সেখানে তিন ধাপের সার্ভেয়ার রয়েছে। প্রথম ধাপে স্নাতকধারী ইঞ্জিনিয়ার প্রাধান্য পেয়ে থাকে।

(ঘ) বীমার দলিলে অনেক জারগন থাকে যা মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয় এগুলো সম্পূর্ণভাবে বাদ দিতে হবে। বীমা দলিলটি হবে সহজ ও বোধগম্য এবং ভবিষ্যতে যা সুবিধা পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে, ব্যর্ত্যয় ঘটলে বীমা ইমেজ কমে যাবে।

(ঙ) ভারতে এজেন্ট নিজেই এ্যাপসের মাধ্যমে তার কমিশনের অর্থ তুলে নিতে পারে, এমনকি অর্থ তুলে নেয়ার রশিদের খরচ তাকে বহন করতে হয় না।

(চ) ভারতে স্বাস্থ্য বীমা খুবই জনপ্রিয় প্রোডাক্ট এবং গত এক বছরে এ খাতে প্রিমিয়ামের ২৭% প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য বীমা চালু করা দরকার। এবং (ছ) ভারতে বীমাকারীরা আউটস্ট্যান্ডিং ক্ল্যাইমের হিসাব গোপন করত। বাংলাদেশেও এটি করা হয় কি না দেখা যেতে পারে।

আমাদের সুপারিশ হলো:

(ক) নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা তাদের ড্যাশবোর্ডে প্রতিদিনের প্রমিয়মের আপডেট দেখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। (খ) সকল বীমাকারীর আইটি সিস্টেম নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার আইটি সিস্টেমের সাথে ইন্টিগ্রেটেড হতে হবে।

(গ) প্রতিটি ইন্স্যুরেন্স এবং রিইন্স্যুরেন্সের পলিসির বিবরণ আইডিআরএ এর আইটি সিস্টেমে চলে আসতে হবে। আইটি সিস্টেম এমন হতে হবে যেন প্রিমিয়াম জমা না হলে এবং কমিশনের হিসেব না হলে কোনো কাভার নোট ইস্যু হতে পারবে না। (ঘ) কৃষিবীমা এবং স্বাস্থ্যবীমা চালু করতে হবে। (ঙ) বীমা বিষয়ক সভা সেমিনার ওয়ার্কশপে বীমা কর্মীর পাশাপাশি ব্যাংকসহ অন্যান্য পেশার লোকজন এবং গ্রাহকদের হাজির করতে হবে।

(চ) অনলাইনে এজেন্ট রেজিস্ট্রেশন, সার্টিফিকেশন এবং লাইসেন্স প্রদানে ব্যবস্থা নিতে হবে। এজেন্টের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ এবং অনলাইন পরীক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব এজেন্ট কাজ ছেড়ে দিবে তারা ৫ বছরে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবে না। (ছ) প্রতি বছর প্রতিটি বীমাকারী অন্তত একজন কর্মকর্তাকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে এসিআইআই ডিগ্রি অর্জনের ব্যবস্থা করবে। (জ) বীমাকারীকে উচ্চশিক্ষিত মেধাবী ও আইটি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিকে উচ্চ বেতনে নিয়োগ দিতে হবে এবং বীমা ছাড়া অন্য আর্থিক সেক্টরে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের নিয়োগ দিতে হবে। (ঝ) সার্ভেয়ার এবং এজেন্টের ডাটা আইডিআরএ-এর সার্ভারে স্টোর করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। (ঞ) এজেন্ট অ্যাপসের মাধ্যমে তার কমিশনের টাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

(ট) ব্যবসার প্রসারের জন্য জনপ্রিয় পরিকল্পের প্রচার এবং উদ্ভাবনী পরিকল্পের ওপর নিয়মিত গবেষণা করতে হবে। (ঠ) নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে বীমাগ্রাহকের বীমা শিক্ষার জন্য একটি আলাদা ওয়েবসাইট চালু করতে হবে। (ড) এনজিওসমূহ যেন এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করে প্রান্তিক মানুষের দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখতে পারে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। (ঢ) বীমাকারী প্রতিষ্ঠানে শেয়ারহোল্ডার এবং পলিসিহোল্ডারের অ্যাকাউন্টস সম্পূর্ণরূপে আলাদা করতে হবে। (ণ) বীমাকারীর ওয়েবসাইটে বীমা দাবির অনিষ্পন্ন তালিকা প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে।

এবং (ত) একজন বীমা গ্রাহক অ্যাপসের মাধ্যমে তার পলিসির অবস্থা জানার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

লেখক: যুগ্ম সচিব, বাংলাদেশ সরকার।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :