এই বিপদ না এলে কী বুঝতাম কেউ এখনো ভালোবাসে

প্রকাশ | ২৯ মার্চ ২০১৯, ১৯:৪১ | আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৯, ১৯:৫৯

সোহেল রানা

রাজধানীর বনানী এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পরপর প্রাথমিক অবস্থা নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন পাশের রেডিও টুডের অফিসে অবস্থানরত সাংবাদিক সোহেল রানা। স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো-

আমরা তখন দুপুরের সংবাদ তৈরিতে ব্যস্ত। হঠাৎ কেউ একজন দৌড়ে এসে বলল পাশের বিল্ডিংয়ে আগুন। সবকিছু ফেলে যে যার মতো ছুটলাম। আগে জীবন, তারপর না অন্য কিছু!

আমাদের রেডিও টুডের অফিস আওয়াল সেন্টারের ১৯ তলাতে। আগুন লেগেছে পাশের এফআর টাওয়ারে। সহকর্মীদের নিয়ে এক দৌড়ে ১৯ তলা সিঁড়ি মাড়িয়ে নামলাম। ততক্ষণে নিচে জমায়েত হয়ে গেছে শত শত মানুষ। দেখা হলো কবির ভাইয়ের (আইটি চিফ) সাথে। জিজ্ঞেস করল, ‘শাহেদ ভাই কি নামছে’? মাথার মধ্যে হঠাৎ বাড়ি খেলো। শাহেদ ভাই আর ফিরোজ তো নামেনি! কয়েকবার কল দিলাম, কল ঢুকছেই না, ফিরোজকে কল দিলাম, কল ঢুকলেও ফোন রিসিভ করছে না। এভাবে কয়েকবার চেষ্টা করলাম। ফোনে পেলে হয়তো বলতাম, ‘ভাই সব ফেলে দিয়ে নামুন, বাঁচলে নিউজ বহুত করা যাবে।’ একটু পর যখন দেখলাম শাহেদ ভাই, ফিরোজ আর আমার নারী সহকর্মীরা নিরাপদে নামতে পেরেছে তখন স্বস্তি নেমে এলো। আমাদের প্রোগ্রাম টিম ও আরজেদেরও নিচে দেখে স্বস্তি পেলাম।

আগুন লেগেছে সাড়ে ১২টার কিছু পরে, আমরা খবর পেয়ে নামতে নামতে ১২ টা ৫০ বেজে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি তখনো আসেনি। মানুষের চোখে-মুখে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। ফায়ার সার্ভিসের নাম্বারটা আমার ফোনে ছিল না, ফোনে ইন্টারেনেটও ছিল না। ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে আগুনের খবর জানালাম। আমার মতো অনেকেই হয়তো ফায়ার সার্ভিস নতুবা ট্রিপল নাইনে ফোন দিয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এসেছে আগুন লাগার ৪০-৫০ মিনিট পরে। এটাও আমার কাছে এক ধরনের বিভীষিকা, বনানীর মত জায়গায় তাদের কেন এতো দেরিতে পৌঁছাতে হয়? জানি না এর উত্তর দায়িত্বরতরা দিতে পারবেন কি-না?

পৌঁছানোর পর কাজ গোছাতে গোছাতে আরো সময় গেছে ত্রিশ মিনিটের মত! ততক্ষণে ১৪, ১৫, ১২, ১৩ এমন বিভিন্ন তলা থেকে তার দিয়ে ঝুলে পড়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে নিচে পড়ে ভর্তা হয়ে গেছেন কয়েকজন। অন্তত সাতজনকে এভাবে ঝুলে পড়তে দেখে বারবার হৃদয়টা ভেঙ্গে যাচ্ছিল। কিছু সময়ের মধ্যেই দেখলাম হাজার হাজার উৎসুক মানুষ বনানীজুড়ে অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। স্পট যেখানে বনানী আর ভবনটা যেহেতু বহুতল আমি প্রত্যাশা করেছিলাম ফায়ার সার্ভিসের শুরুর প্রস্তুতিটাই হবে বড়। কিন্তু তাদের প্রাথমিক প্রস্তুতি আমাকে হতাশ করেছে।

অবশ্য ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটা কর্মীর আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। তারা জীবন বাজি রেখেই কাজ করেছেন। সমস্যাটা আসলে সিস্টেমেটিক। এ রকম আরো একটা সিস্টেমেটিক সমস্যা হলো এদেশের উৎসুক জনগণ। হাজার হাজার জনতা রাজপথ দখল করে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় ওয়াসার পানির গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্সগুলা ঠিকমত মুভ করতে পারছিল না। আগুন নেভাতে কাজ করছিল ফায়ার সার্ভিসের কুড়িখানেকেরও বেশি ইউনিট। আকাশে উড়ছিল সেনা ও বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ও বিমান। বিমান থেকে আগুন ও ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণকারী রাসায়নিক ছিটানো হচ্ছিল। তখনো অনেকেই জানালার কাচ ভেঙ্গে হাত নেড়ে নেড়ে অসহায়ভাবে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলেন। তাদের বেঁচে থাকার আকুতি রাস্তায় জড়ো হওয়া লাখ লাখ মানুষের চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেককেই হাউমাউ করে কাঁদতে দেখেছি যেন বিপদটা তার নিজের।

এক পরিবারের কয়েকজনকে দেখলাম বনানী সুপার মার্কেটের সামনে বসে গেছে, তাদের তিনজন ভবনটিতে আটকা পড়ে আছে। প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়া এক মা বারবার পানি চাচ্ছিল, তার এক ছেলে ফোনে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। জানি না তাদের কার কী পরিণতি হয়েছে। জীবন-মৃত্যুর মালিক মহান আল্লাহ, এর ফয়সালা জমিনে হয় না, হয় আসমানে।

শুকরিয়া। আজ সারাদিন অসংখ্য ফোন এসেছে, ইনবক্সে খবর নিয়েছেন কেউ কেউ। সত্যি বলতে কি জীবনে এতো ফোন কখনো পাইনি। কেউ কেউ ফোন করে এতো ইমোশনাল হয়ে গেছেন যে, একজন  বলতেছে, ‘সোহেল তুমি আমার অফিসে চলে আসো’। সত্যিই আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। এই বিপদ না এলে কী করে বুঝতাম কেউ না কেউ আমাকে এখনো ভালবাসে। একটা বিপদ মানুষের জন্য কখনো কখনো শিক্ষা, কখনো কখনো আশীর্বাদ।

আশীর্বাদ এই অর্থে যে আমি আমার ভালবাসার মানুষগুলোকে চিনতে পেরেছি, জানতে পেরেছি। কিন্তু বিপদ থেকে শিক্ষা নেওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ যা আমরা কখনোই নেই না।

লেখক: রেডিও টুডের সাংবাদিক।

(ঢাকাটাইমস/২৯মার্চ/বিইউ/মোআ)