‘মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে ফিরব ভাবিনি’

আরিফ আজম, ফেনী থেকে
| আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০১৯, ২১:০৯ | প্রকাশিত : ০১ এপ্রিল ২০১৯, ২১:০৫

‘পুরো অফিস ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঘটনার ভয়াবহতায় চিৎকার-চেঁচামেচি আর কান্নায় ভেঙে পড়েন সহকর্মীরা। কেউ কোনো দিক দিয়ে বের হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা মনে পড়লে ভাবতেই পারছি না- এখনো বেঁচে আছি। কারণ বেঁচে ফিরবো কখনোই ভাবিনি।’ এভাবেই বনানী এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনার বর্ণনা দিলেন আহত মোরশেদ জাহান হিমু। ভবনের দশম ফ্লোর থেকে বাইরের ক্যাবল তার বেয়ে নিচে নেমে আসেন তিনি। ভয়ানক ওই আগুনে তার সহকর্মীদের ১০ জন মারা গেছেন। কেউ লাফ দিয়ে, কেউ দম বন্ধ হয়ে মরার পর আগুনে পুড়েছেন।

মোরশেদ জাহান হিমু ফেনী শহরের বিরিঞ্চি এলাকার কদলগাজী রোডের বাসিন্দা রেলওয়ে কর্মরত শাহজাহান বাবুলের একমাত্র ছেলে। তার এক বোন ফেনী সরকারি কলেজে অনার্স অধ্যয়নরত।

২০১০ সালে ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এসএসসি, ২০১২ সালে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ অধ্যয়নরত হিমু পড়াশোনার পাশাপাশি হেরিটেজ এয়ার এক্সপ্রেস লিমিটেডে চাকরি করছেন। ২২ তলা ভবনটির ১০তলায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়। ছয়মাস আগে এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন তিনি।

ঢাকাটাইমসকে বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা করছিলেন হিমু। বলেন, বৃহস্পতিবার সাড়ে ১২টার দিকে ৮ম তলায় আগুন লাগে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের এমডি ফয়েজুল ইসলাম স্যার ফোনে ছাদে যেতে বললেন। কিন্তু আমরা কেউ যেতে পারিনি। তখন সবাই পরিবারের সাথে ফোনে ব্যস্ত। সহকর্মী আবু হেনা ইফতি ফোনে স্বজনদের বলছিলেন বেঁচে ফিরলে দেখা হবে। তার এ কথায় আরো ঘাবড়ে যাই। নিচেও নামতে পারছি না, উপরেও উঠতে পারছি না।

‘কনফারেন্স রুমে গিয়ে দেখলাম একটি গ্লাস আছে। ঝুঁকি জেনেও ওই গ্লাসটি ভেঙে ভবনের বাইরে এসির জন্য তৈরি লোহার উপরে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। প্রথমবার সাহস না পেয়ে ভয়ে অফিসের ভেতরে ঢুকে পড়ি। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করি। লাফ দিবো, যা হওয়ার হবে। এ সময় দেখি বাইরে বিদ্যুৎ, ডিস, ওয়াফাইসহ আরো কিছু কেবলের তার। পা দিয়ে টেনে ধরে সেগুলোতে ঝুলে পড়লাম। ২০ মিনিট ধরে ঝুলতে থাকলাম। মনে সাহস নিয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকলাম।’

‘৫ম কিংবা ৪র্থ তলা পর্যন্ত নেমে আটকে যাই। ততক্ষণে শরীরের সবশক্তি হারিয়ে ফেলি। ৩য় তলা পর্যন্ত নামার পর নিচে উৎসুক লোকজন সাহস দিচ্ছিলেন। ভারী একটা কিছু ডান হাতে পড়ে আঘাত পাই। যখন নামছিলাম তখন একটিবারের জন্যও নিচের দিকে তাকাইনি। উপরের দিকে তাকিয়ে ভাবি হয়তো আর অল্প একটু। শরীরে শক্তি না থাকলেও মনোবল নিয়ে নামতে থাকি। এরপর নিচ থেকে ১০ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত আসি তখন একজনের কাঁধে পা রেখে ভর করে নেমে ফুটপাতে বসি।’

তখনো ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স কিংবা কোনো সাহায্যকারী সংস্থা এসে পৌঁছেনি বলে জানান হিমু। বলেন, পরে ফুটপাত থেকে তাকিয়ে আমাকে অনুসরণ করে অফিসের পিয়ন বেলাল ও এক সহকর্মী নেমে আসেন। আরো দুইজন মামুন ভাই ১০ তলা থেকে পড়ে মারা যান। মুনির ভাই দুইজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে মারা যান। ‘জেমি ভাই, রুমকি আপা দু’জনই স্বামী-স্ত্রী। চাকরি করতেন একই অফিসে। রুমকি আপা দম বন্ধ হয়ে মারা যান। জেমি ভাই লাপ দিয়ে মারা যান। খবর পাই আমার অফিসের ১০ জন সহকর্মীই মারা যান।’

হিমু আরো জানান, ‘আমি নামার সময় অন্য সহকর্মীদের নামতে সাহস যোগাই। কিন্তু কেউ সাহস করেননি। সাহস হারিয়ে তারা জীবনের আশা ছেড়ে দেন। অনেকে দম বন্ধ হয়ে মারা যান। পরবর্তীতে আগুনে তাদের মৃতদেহ পুড়ে যায়। জেবিন আপুকে (জেবুন্নেসা) বেশি মিস করছি।

আবেগাপ্লুত স্বরে হিমু বলেন, তার কোনো ভাই নেই। তিনি আমাকে ভাই বলে ডাকতেন। উনি শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন। তাকে আমি বাঁচাতে পারিনি। তানজিলা আপুর শরীরের ৯৮ শতাংশ পুড়ে যায়।’

এ দুঃস স্মৃতি নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কি না তা শঙ্কায় আছেন হিমু। বলেন, জানি না আমি কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবো। এ স্মৃতি আমাকে ভাবায়, কাঁদায়। চেনা মানুষগুলো আমার চোখের সামনে এভাবে মৃত্যুর মুখে পড়ে গেলো।

ভবনে অপ্রতুল অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, যথেষ্ট ফায়ার এক্সিট না থাকা ও ফায়ার অ্যালার্মিং না থাকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন হিমু। বলেন, ‘আমরা সবাই বেঁচে ফিরতে পারতাম যদি একটা ফায়ার অ্যালার্মিং থাকতো বা বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকতো। মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখেও এক দুনিয়ায় আমি দ্বিতীয়বার জীবন পেয়েছি। মা-বাবা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। আমাকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন ছিলো। এজন্য মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে ফিরেছি। তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’

ঢাকাটাইমস/০১এপ্রিল/ইএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :