ছাত্রলীগের মনে রাখা উচিত নুর এখন ডাকসুর ভিপি

আলম রায়হান
| আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:৪৪ | প্রকাশিত : ০৩ এপ্রিল ২০১৯, ১৩:৪২

প্রত্যাশা ছিলো, ঐতিহাসিক নানান ঐতিহ্যের ধারক আজকের ছাত্রলীগ হুঁশে আসবে। এই প্রত্যাশায় ভিত্তি করে ‘এই নুর সেই নুর: এবার হুঁশে আসবে ছাত্রলীগ?’ শিরোনামে আমার একটি কলাম ১৩ মার্চ ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোরে প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রলীগ হুঁশে আসবে- এমন প্রতাশা ছিলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিগুলোর। বিপরীতে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিগুলো চাচ্ছিল, ছাত্রলীগ যাতে হুঁশে না আসে। মঙ্গলবার ২ এপ্রিলের ঘটনায় প্রমাণিত হলো, স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিগুলোর প্রত্যাশাই পূরণ হয়েছে।

প্রকাশিত খবর হচ্ছে, এসএম হলের প্রাধ্যক্ষকে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক, সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন, শামসুন নাহার হল সংসদের ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজ, ডাকসুতে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী অরণি সেমন্তি খান ও ছাত্র ফেডারেশন থেকে ডাকসুর জিএস প্রার্থী উম্মে হাবিবাসহ বেশ কয়েকজন।

উল্লেখিত এ ঘটনায় অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আমিও মর্মাহত। এবং খুবই ‘আতঙ্কের সঙ্গে’ ছাত্রলীগের বর্তমান কর্নধারদের মনে করিয়ে দিতে চাই, নুরকে নিয়ে আগে যা হবার হয়েছে; নুরুল হক নুর এখন কিন্ত ডাকসু ভিপি। এ কথা মনে করিয়ে দেবার ক্ষেত্রে আমার আতঙ্কের কারণ দুটি। এক. যারা ডাকসু ভিপির উপর হামলা করতে পারে তারা আমার মতো অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের উপরও অতি সহজে হামলা করার ক্ষমতা রাখে। দুই, ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ এপ্রিল যে আচরণ করেছে তা অব্যাহত থাকলে স্বাধীনতা বিরোধীরাই উপকৃত হবে এবং এটিকে বড় রকমের পুঁজি বানাবার চেষ্টা করতে পারে ৭৫-এর থিংকট্যাংক। অতএব সেই পুরনো বহুল শ্রুত বাক্যই বলতে হয়, সাধু সাবধান!

প্রায় ১৫ দিন আগে ১৩ মার্চ প্রকাশিত আমার কলামের শেষ অনুচ্ছেদ ছিলো, ‘সকলেরই স্মরণে আছে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় এই নুরুল হককে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পা জড়িয়ে ধরে বাঁচার আর্তনাদের ছবি দেখলে এখনো অনেকের চোখ ভিজে আসে। মানুষকে মানুষ এভাবে মারতে পারে! এখানেই শেষ নয়। তাকে জেলে দেয়া হয়েছে। এমনকি বেসরকারি হাসপাতালেও প্রকাশ্যে চিকিৎসা দেয়া হয়নি। পরিবারকে অপমান করা হয়েছে। সারা জীবন সরকারি চাকরি না দেয়ার হুমকি দিয়েছে অতি উৎসাহী গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু নুর দমেনি। বরং গুরুর মতোই দৃঢ় থেকেছেন শুরু থেকেই। মাটি কামড়ে থেকেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশার সঙ্গে। বৈরী স্রোতের বিপরীতে টিকে ছিল সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। বাঘের খাঁচায় থেকে বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করার সাহস দেখিয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর পুরস্কার দিলো ভিপি নির্বাচিত করে। নুরুল হক নুর শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাকে অসম্মান করলে শিক্ষার্থীদেরই অসম্মান করা হয়- শোভন সেটা বুঝতে পেরেছেন বলে আমার ধারণা। আশা করি তার নেতৃত্বে থাকা ছাত্রলীগের কর্মীরাও সেটা বুঝবেন। নুর-শোভনদের নেতৃত্বে ছাত্ররাজনীতি গ্রহণযোগ্য এবং ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসবে। এমনটাই ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা।”

ছাত্রলীগের একটি অংশ ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা বারবার অবজ্ঞা করছে, যা ডাকসু নির্বাচনের পরও নগ্নভাবে নজরে পড়েছে সবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ভোটে ভিপি নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও নুরুল হককে প্রথমে মেনে নেয়নি ছাত্রলীগ। প্রতিবাদের নামে ১২ মার্চ ক্যাম্পাসে দিনভর অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নবনির্বাচিত ডাকসু ভিপিকে গরুপেটা করে ক্যাম্পাস ছাড়া করেছে ছাত্রলীগের কতিপয় গুণধর কর্মী। কিন্তু গুণধররা তখন বিবেচনায় নেয়নি, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যাশা ধারণ করে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগের একদল কর্মী চরম নির্যাতন করেও এই নুরুল হক নুরকে দমাতে পারেনি। সেই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি শোভনের উদারতায় ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের পরিবেশ শান্ত হয়।

এরপর প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রিত অনুষ্ঠানে যোগদান এবং ভিপি হিসেবে দায়িত্ব নেবার মাধ্যমে নুরুল হক নুর উচ্চমানের প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। অনেকেই মনে করেন, বাস্তব জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুর। যা জাতীয় রাজনীতে বিএনপির মতো দলও পারেনি।

একটু গভীরভাবে বিবেচনা করলেই বুঝা যাবে, নুরুল হক নুরকে অপমান অপদস্ত করে ছাত্রলীগ অথবা অন্য কেউ কোন কিছু অর্জন করেতে পারবে না। সম্ভবত এই বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা এখনো বিবেচনায় নেননি। যে কারণে ২ এপ্রিলের ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগের একটি অংশ। কিন্তু দায় নিতে হবে পুরো সংগঠনকে।

প্রকাশিত খবর অনুসারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল সংসদ নির্বাচনে জিএস পদে ছাত্রলীগ থেকে মনোনয়ন না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন ফরিদ হাসান। অভিযোগ ওঠেছে, বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে তাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়। সেই ঘটনার সূত্র ধরেই গত ১ এপ্রিল রাতে এসএম হল সংসদের জিএস জুলিয়াস সিজার ও হল শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে ফরিদকে মারধরের অভিযোগ ওঠে। এর বিচার চেয়ে ২ এপ্রিল মঙ্গলবার এসএম হলের প্রাধ্যক্ষকে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক, সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন, শামসুন নাহার হল সংসদের ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজ, ডাকসুতে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী অরণি সেমন্তি খান ও ছাত্র ফেডারেশন থেকে ডাকসুর জিএস প্রার্থী উম্মে হাবিবাসহ বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে উম্মে হাবিবা আঘাত পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ফরিদের ওপর হামলার বিচারের দাবিতে মঙ্গলবার প্রক্টর কার্যালয়ে যান নুরুল হকসহ অন্যরা। প্রক্টর কার্যালয় থেকে তাদের এসএম হলের প্রাধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিতে বলা হয়। হলের ভেতর ঢুকলে নুরুল ও আখতারের সঙ্গে থাকা অন্যদের ‘বহিরাগত’ আখ্যা দিয়ে তাদের প্রাধ্যক্ষের কক্ষে অবরুদ্ধ করে ফেলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় ওই কক্ষে ঢুকতে চাইলে সাংবাদিকদেরও লাঞ্ছিত করা হয়। হল প্রাধ্যক্ষ মাহবুবুল আলম জোয়ার্দার ভিপিসহ অন্যদের নিরাপদে বের করার চেষ্টা করেন। তিনিও তাদের সঙ্গে বের হন। এ সময় ডিম নিক্ষেপ করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছাত্রনেতারা ছাড়াও এ সময় প্রাধ্যক্ষের গায়ে ডিম পড়ে। হলের মূল ফটকের বাইরে থাকা অরণি সেমন্তি খান, উম্মে হাবিবা, শেখ তাসনিম আফরোজসহ অন্যদেরও লাঞ্ছিত করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে এসএম হলের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে এসে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ডাকসুর ভিপি নুরুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগকে তুষ্ট রেখে কাজ করছে।

উল্লেখ্য, মারধরের শিকার হওয়া ফরিদ হাসানের কপালের ডান পাশ ও ডান কানে মোট ৩২টি সেলাই দিতে হয়েছে। এদিকে তাকে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে হল সংসদের জিএস জুলিয়াস সিজার মাছ দিয়ে শাক ঢাকার মতো বলেছেন, ‘ফরিদের বিরুদ্ধে মাদক সেবনের অভিযোগ থাকায় হল ছাড়তে বলা হয়েছে। উত্তেজিত সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাকে মারধর করে থাকলে সেটির দায় ছাত্রলীগের নয়।’

এসএম হল সংসদের জিএস জুলিয়াস সিজারে দাবি মতো ফরিদ হাসানকে মারধর করার দায় ছাত্রলীগের না হলেও ভিপি নুরসহ অন্যদের লাঞ্ছিত করার দায় কাদের? ঘটনার শিকার ভিপি নুরসহ অন্যরা এর জন্য ছাত্রলীগকেই দায়ী করেছেন। এবং এর সঙ্গে পাবলিক পারসেপশনও কিন্তু সমান ধারায় রয়েছে। আমি আবার মনে করিয়ে দিতে চাই, মুকুটে ক্ষমতার পালককে মনুমেন্ট মনে না করে ছাত্রলীগকে দেয়াল লিখন পড়তে হবে। ছাত্র-জনতার ভাবনার প্রতি শ্রদ্ধা থাকা প্রয়োজন ছাত্রলীগের। আরও বিচেনায় রাখা উচিত, অগ্নিকাণ্ডের কারণ যাই হোক, বনানীর এফআর টাওয়ারের অবাঞ্ছিত ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অনেক। কোন কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা করা কী ঠিক হবে?

আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :