খুনের জেরে অগ্নিসংযোগ

নিঃস্ব ২০ পরিবারের মানবেতর জীবন

মাদারীপুর প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৫ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:৩৬
মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের ব্রাক্ষ্মদী এলাকার হায়দার মোল্লার বাড়িটি ভাঙচুর করা হয়

মাদারীপুরে একের পর এক খুন হচ্ছে। এক মাসে খুন হয়েছে পাঁচটি। এসব খুনের জেরে প্রতিদিনই ঘটছে কোনো না কোনো বাড়ি-ঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা।

এরই মধ্যে মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের ব্রাক্ষ্মন্দী এলাকায় কমপক্ষে ২০টি বাড়ি-ঘরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে এসব এলাকা এখনো পুরুষশূন্য। নিঃস্ব ওইসব পরিবারের লোকজন খোলা আকাশের নিচে বা অন্যের আশ্রয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। এতে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে বলে দাবি করছেন এলাকার লোকজন ও সুশীল সমাজ।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ মার্চ শনিবার রাতে খুন হন মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের শিমুলতলা এলাকার মোয়াজ্জেম মোল্লা। এর জেরে জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছে ঝাউদির বিভিন্ন এলাকা। এই সুযোগে নিরীহ লোকজনের ঘর-বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এর মধ্যে ইউনিয়নের ব্রাক্ষ্মন্দী এলাকার সিকিম আলি চৌকিদারের বাড়ি-ঘর গত ১ এপ্রিল রাত দশটার দিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। নিঃস্ব হয়ে গেছে পুরো পরিবার। ঘরের টিভি ফ্রিজ, আলমারি, নগদ টাকা, গরু-ছাগলসহ সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

সরেজমিনে গিয়ে পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে বিলাপ করতে দেখা গেছে ক্ষতিগ্রস্ত আছিয়া বেগমকে। তিনি বলেন, ‘আমরা মাইর কাইজ্জার মধ্যে নাই, এরপরেও আমাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। আগে এই এলাকার হারুন মোল্লার সঙ্গে একটু শত্রুতা ছিলো। সেই শত্রুতার কারণে আমাদের ঘরে আগুন দিছে। আমরা জড়িত না, তাই আমাদের কেউ মামলার আসামিও না। আগে আমাদের অনেক কিছু ছিলো, এখন পরের ঘরে রাতে থাকতে হয়। আমরা এর বিচার চাই।’

একই চিত্র কুলপদ্ধি, ঝাউদি ও ব্রাক্ষ্মন্দী এলাকায়। ব্রাক্ষ্মন্দীর ছালাম মোল্লা, হায়দার মোল্লা, হায়দার হাওলাদার, করম বেপারী, সোবাহান সর্দার, রাজ্জাক বেপারী, তোতা বেপারী, মফেজ সর্দার, শহিদ সর্দারসহ কমপক্ষে ২০টি বাড়িতে লুটপাট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নিঃস্ব এ পরিবারগুলোও এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ছালাম মোল্লা বলেন, ‘হত্যার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের শাস্তি দেওয়া হোক, এটা আমরাও চাই। তার জন্য আমাদের কেন বাড়ি-ঘর ভাঙচুর-লুটপাট করা হবে। আমরা ঘটনার সঠিক বিচার চাই।’ একই কথা বলেন তোতা বেপারী, মফেজ সর্দার, শহিদ সর্দারসহ ক্ষতিগ্রস্তরা।

অন্যদিকে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে মাদারীপুর শহরে আসার পথে বাংলাবাজার এলাকায় সাহেব আলী নামে একজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। সাহেব আলীর অবস্থার অবনতি হলে বিকালে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। এই ঘটনার পর থেকে এলাকায় প্রতিপক্ষের বাড়ি-ঘরে দফায় দফায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। উত্তেজিত জনতা এলাকার অর্ধশত বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট ও একাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।

পুড়িয়ে দেয়া ঘরের সামনে বসে বিলাপ করছেন ঝাউদি ইউনিয়নের ব্রাক্ষ্মদী এলাকার আছিয়া বেগমশিবচর উপজেলার দ্বিতীয়াখণ্ড ইউনিয়নের মৃধাকান্দি গ্রামের আলেম মৃধার সঙ্গে একই বাড়ির জলিল মৃধাদের দীর্ঘদিন ধরে জমিজমা নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। এই বিরোধের জেরে গত ১০ মার্চ সকাল দশটার দিকে দুই পক্ষের নারী-পুরুষের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। এর এক পর্যায়ে দুপক্ষের ধ্বস্তাধ্বস্তির সময় প্রতিপক্ষের ধাক্কায় আলেম মৃধার স্ত্রী সর্ব বেগম গাছের শিকড়ের উপর আছড়ে পড়েন। পরিবারের লোকজন শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এতেও থানায় মামলা হয়েছে।

গত ২৫ মার্চ মাদারীপুর শহরের আমিরাবাগ এলাকার ভূঁইয়া কমিউনিটি সেন্টারের পেছনে লিয়াকত আলীর নির্মাণাধীন ভবনের দোতলা থেকে জেলা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি লিমন মজুমদারের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় লিমনের বাবা ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এই হত্যার বিচারের দাবিতেও চলছে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ।

এছাড়া হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর ঘটনায় চারদিন আহত থাকার পর গত ১ এপ্রিল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাসেল খান নামে ২৫ বছর বয়সী এক যুবক মারা যান। এসব ঘটনায় আতঙ্কিত মাদারীপুরবাসী। তারা সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিচার দাবি করেন।

মানবাধিকার কর্মী সুবল বিশ্বাস বলেন, ‘হত্যা বা খুনের ঘটনায় দোষীরা শাস্তি পাবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই ঘটনার জের ধরে এই শ্রেণির সুবিধাভোগী বাড়ি-ঘর লুটপাট বা হামলা-মামলা চালাবে, এটি ঠিক না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত এসব বিষয় খুঁজে বের করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা।’

মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল হাসান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, ঝাউদির ব্রাক্ষ্মদী এলাকার দুপক্ষকেই শান্ত রাখাতে। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আগুন দেওয়ার ঘটনায় মূল আসামি হারুন মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদার জানান, ‘হত্যার পর প্রাথমিক কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু এরপরে যদি এসব ঘটনার জেরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে দোষীদের ছাড় দেয়া হবে না। এরই মধ্যে কয়েকজন বিশৃঙ্খলাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।’

(ঢাকাটাইমস/০৫এপ্রিল/প্রতিবেদক/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :