যেভাবে এলো ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ টি-শার্ট

বাসে একজন নারী দাঁড়িয়ে আছেন, যার গায়ে পরিহিত টি-শার্টে লেখা ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’। গত কয়েকদিন ধরে এমন কয়েকটি ছবি ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মাঝে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ঢাকার একটি ইন্টারনেট ভিত্তিক নারীদের পোশাক ও অলংকার তৈরির প্রতিষ্ঠান এই ডিজাইনের টি-শার্ট তৈরি ও বাজারজাত করেছে।

প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারীদের একজন এবং টি-শার্টের ডিজাইনার জিনাত জাহান নিশা। তিনি জানান, গণপরিবহনে নিজের সঙ্গে হওয়া হয়রানিমূলক ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবেই এ ধরণের পণ্য তৈরি করার চিন্তা আসে তার মাথায়। কয়েক বছর আগে বাসে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি।

নিশা বলেন, একজন বয়স্ক ব্যক্তির দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর বাসেই প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু সেসময় সেখানে উপস্থিত মানুষজন আমাকে সহায়তা না করে উল্টো প্রতিবাদ থামানোর জন্য চাপ দেন।’

তিনি বলেন, ‘নিজে হয়রানির শিকার হওয়ার পরও প্রতিবাদ করতে না পারা এবং উপস্থিত মানুষজনকে অন্যায়কারীর পক্ষ নিতে দেখে সেদিন খুবই অপমানিত হয়েছিলাম। ওই ঘটনার আগেও যৌন হয়রানির শিকার হলেও সেবারের ঘটনা আমার ওপর অন্যরকম প্রভাব ফেলেছিল।’

এর পরপরই নাকি প্রতিবাদ হিসেবে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ লেখা একটি খোঁপার কাঁটা তৈরি করেন এবং তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাজারে ছাড়েন। নিশার কথায়, ‘ছবি আঁকা, ডিজাইন করার মত কাজগুলোর মাধ্যমেই আমি আমার অনুভূতি শেয়ার করি এবং হালকা বোধ করি।’

খোঁপার কাঁটাটি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে বাজারে ছাড়া হলেও এই পণ্যের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল না বলে জানান নিশা। তিনি মনে করেন, গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার অধিকাংশ নারীই তাদের সঙ্গে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন না। সেসব নারীদের প্রতিবাদের একটি মাধ্যম হিসেবে গত বছর নববর্ষের আগে খোঁপার কাঁটাটি বাজারে ছেড়েছিলাম।’

খোঁপার কাঁটাটি বাণিজ্যিক সফলতা না পেলেও ওই পণ্য সম্পর্কে দারুণ ইতিবাচক সাড়া পাওয়ায় এবছরেও একই বার্তা সম্বলিত পণ্য বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করেন নিশা।

তিনি বলেন, ভিড় বাসে নারীদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা খুবই সাধারণ। গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেকেই ভিড়ের সুযোগটা নেন, যার প্রতিবাদ করা প্রয়োজন।’

নিশা দাবি করেন, ‘বাসে অনেক পুরুষের সঙ্গেই ছোঁয়া বা ধাক্কা লাগলেও সেসব পুরুষের মধ্যে কারা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেন তা একজন নারী সহজেই বুঝতে পারেন। ধাক্কা লাগলে বা গা ঘেঁষে দাঁড়ালে কোনো সমস্যা নেই। ভিড় বাসে এরকম হতেই পারে। কিন্তু অনেকেই সেই অবস্থার সুযোগ নেন, যেটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

ফেসবুকে যেমন প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে

‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ লেখা টি-শার্টের ছবি ভাইরাল হওয়ার পর এনিয়ে বিভিন্ন রকম আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকে। আবার অনেকেই এর সমালোচনা করেছেন।

মোস্তাফিজুর নূর ইমরান নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘লোকে তো অনেক কিছু্‌ই বলবে, লোকের কাজই বলা। এগিয়ে যাও।’

অনেকে প্রশংসা বা অনুপ্রেরণা দিয়ে মন্তব্য করলেও নেতিবাচক মন্তব্য করা মানুষের সংখ্যাই বেশি বলে মনে করেন নিশা। নেতিবাচক মন্তব্যকারীদের অধিকাংশই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নারীদের টি-শার্ট পরার বিষয়টির সমালোচনা করেছেন।

অনেকেই বলেছেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নারীদের এমন পোশাক পরা উচিত নয়। করিম নামে এক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘মানুষের কমেন্টগুলো দেখুন। আপনাদের বোঝা উচিত এটা বাংলাদেশ।’ অনেকেই আবার এই ছবিগুলোকে বিক্রি বাড়ানোর কৌশল বলে উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু নিশা দাবি করেন, বিক্রি বাড়ানোর পদ্ধতি বা আলোচনায় আসার কৌশল হিসেবে এই পণ্য তৈরি করেননি তারা। বাংলাদেশের গণপরিবহন, রাস্তাঘাটে নারীরা যেমন হয়রানির শিকার হন তার প্রতিবাদ হিসেবে বাজারে ছেড়েছেন এই পণ্য।

তিনি বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যমে এই ছবিগুলো ভাইরাল করার উদ্যোগ কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। যারা এগুলো নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন, ছবি বিকৃতভাবে এডিট করে ট্রোল করছেন, তারাই এটিকে ভাইরাল করেছেন।’

তবে এভাবে সমালোচনা ছড়িয়ে পরার ফলে টি-শার্ট তৈরির উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বলে মনে করেন নিশা। তার কথা, ‘যাদের উদ্দেশ্যে এই লেখা সম্বলিত টি-শার্ট তৈরি করা, তাদের গায়ে ঠিকই লেগেছে এবং তারাই কিন্তু এর সমালোচনা করছেন।’

ঢাকাটাইমস/৭এপ্রিল/এএইচ