খালেদার প্যারোল ও জামায়াত ভেঙে নতুন দলের প্রস্তুতি

বাছির জামাল
 | প্রকাশিত : ০৯ এপ্রিল ২০১৯, ১০:৫৯
ফাইল ছবি

দেশের রাজনীতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে চলছে সরগরম আলাপ। তিনি প্যারোলে মুক্তি নিতে আবেদন করবেন না করবেন না। সংবাদপত্রের খবর হচ্ছে, এ নিয়ে পর্দার আড়ালে সরকার ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করলেই বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব চূড়ান্ত হবে। যদিও এ ব্যাপারে দুই পক্ষের কেউই নাম প্রকাশ করে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। মুক্তি পেলে সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্যে চিকিৎসা নিতে পারেন খালেদা জিয়া। এর আগেও কয়েক দফা দেশ দুটিতে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।

বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি মিললে শপথ নিতে পারেন বিএনপির ছয় সংসদ সদস্য। বিএনপির সঙ্গে সরকারের এ রকমই একটি সমঝোতার কথা শোনা যাচ্ছে। তবে সব কিছু স্পষ্ট হতে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে বলে জানা গেছে। এটা সত্য যে, বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কাছে এখন এক নম্বর এজেন্ডা হচ্ছে তাদের চেয়ারপারসনকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা।

খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরাও চান এটি। তাদের ধারণা, আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি আরও বিলম্ব হতে পারে। তাছাড়া বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আইনি প্রক্রিয়ায় কিংবা রাজপথের কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলে চেয়ারপারসনকে মুক্ত করা কঠিন। এতে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই যেকোনো মূল্যে তাদের চেয়ারপারসনের সুচিকিৎসার উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা। এর অংশ হিসেবে নেপথ্যে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির দুই নেতা। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার সঙ্গে। সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন তারা।

খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে সরকার প্রথম থেকেই ইতিবাচক। অসুস্থ হওয়ার আগে গত বছর ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বিএনপি চাইলে বিদেশে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। সরকার এবং বিএনপির মধ্যে এক ধরনের ছাড় দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। একদিকে খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি পাবেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন; অন্যদিকে বিএনপির সংসদ সদস্যরা শপথ নেবেন। যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ৭ মার্চ শপথ নেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জয়ী গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। ওই দিনই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করার পাশাপাশি তার সদস্যপদ বাতিলের অনুরোধ জানিয়ে স্পিকার এবং সিইসিকে চিঠি দেওয়ার কথা গণফোরামের। কিন্তু দেই, দেব করে এ চিঠি এখনো দেওয়া হয়নি। উপরন্তু ঐক্যফ্রন্টের আরেক সদস্য মোকাব্বির খানও শপথ নিয়েছেন। তাকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। আগামী ২০ এপ্রিল গণফোরামের প্রেসিডিয়াম বৈঠক রয়েছে। সেখানেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নেবেন বলেই এ চিঠি দেওয়া হচ্ছে না। রাজনৈতিক সমঝোতার অংশ হিসেবে ‘ধীরে চলো নীতি’ অবলম্বন করছেন তারা। এ কারণে কোনো কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও সক্রিয় নেই বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একইভাবে রাজনৈতিক সমঝোতার অংশ হিসেবেই কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার নিয়ে যাওয়া হয়েছে খালেদা জিয়াকে। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে উন্নত চিকিৎসার।

খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে তারই আইনজীবী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বিশেষ ক্ষেত্রে সাজাপ্রাপ্ত আসামি, কয়েদি ও হাজতিকে সরকার প্যারোলে মুক্তি দিতে পারে। সেটা হতে পারে চিকিৎসার জন্য বা জানাজায় অংশ নিতে। সাজাপ্রাপ্ত হলে প্যারোল হবে নাÑ এ বক্তব্য সঠিক নয়। তিনি বলেন, কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্ত হবেন কি না সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

সরকারকেও প্যারোলে মুক্তির সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে সময় একটা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু পরে প্রয়োজনে তা বৃদ্ধি করা যায়। তিনি বলেন, আমি এক সময় ম্যাডাম খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির কথাটা বলেছিলাম। তখন বিএনপি হাইকমান্ড এটাকে সহজভাবে নেয়নি। তারা মনে করেছিলেন এটা বিএনপির রাজনীতিতে পরাজয় হবে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, জেলকোড অনুযায়ী কোনো আসামিকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার বিধান নেই। প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। সরকার ইচ্ছা করলে কাউকে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্যারোলে মুক্তি দিতে পারে। এর আগে সেনাসমর্থিত সরকারের সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।

জামায়াত ভেঙে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ!

রাজনৈতিক এ ডামাডোলের মধ্যে দেশে আরেকটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে। সম্প্রতি জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত দলটির মজলিসে শূরা সদস্য মজিবুর রহমান মঞ্জুর কাছ থেকে খবরটি পাওয়া গেছে। তিনি এ নিবন্ধকারকে জানিয়েছেন, আগামী ২৭ এপ্রিল এই ঘোষণা আসতে পারে। নতুন আরেকটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তাও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।

তিনি বলেছেন, এক. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলনে সংস্কারের যে ধারা আশির দশকে শুরু হয়েছিল তার স্পন্দন বাংলাদেশেও সঞ্চারিত হয়। ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমা পেরিয়ে আমরা সেই ধারারই প্রতিনিধিত্ব করছি।

দুই. একটা লম্বা সময় ধরে এই ধারার লোকেরা চেষ্টা করেছে ভেতর থেকে সংস্কার করার জন্য। আদর্শিক নীতি ও নিয়ম মেনে সেসব যথাযথ ফোরামে তুলে ধরা হয়েছে। কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ, ডাটাভিত্তিক তথ্য, সুনির্দিষ্ট পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা লিখিত আকারে বিভিন্ন ফোরাম ও নীতি-নির্ধারকদের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো চেষ্টাই ফলপ্রসূ হয়নি। বিভিন্ন সময় ও পর্যায়ে সংস্কারবাদী আখ্যা দিয়ে এই উদ্যোগের প্রবক্তা ও সমর্থনকারীদের কোণঠাসা করা হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তিন. একটা সময়ে এসে এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ভেতর থেকে সংস্কারের কোনো সুযোগ নেই। যারা সংস্কার চান তাদেরকে হয় ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে হবে অথবা সংগঠন থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেদের নতুন করে স্বতন্ত্র কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে।

চার. সংগঠন থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজস্ব সংস্কার চিন্তার আলোকে নতুন ধারা তৈরি করা খুবই কঠিন একটি কাজ। অতীতে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ কোনো পদক্ষেপ নিয়ে সফল হননি এ রকম একটা কথা সমাজে প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাছাড়া বেরিয়ে যাওয়া লোকদের নানা অপবাদে অভিষিক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো এবং তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করাটাও ছিল একটা কার্যকর অস্ত্র। অতীতে যারা সংস্কারের কাজ করেছেন তারাও অনেকে সংগঠিত হয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেননি। ফলে বাস্তবে সংস্কারমূলক কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সফলভাবে এগোয়নি।

পাঁচ. বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা কী করতে পারি এ বিষয়ে আলাপ করতে গিয়ে আমরা যে সব পরামর্শ পেয়েছি সেগুলোর সারসংক্ষেপ হলোÑ প্রথমত, মানুষ পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে আছে। তারা নতুন কোনো পরিবর্তনমূলক পদক্ষেপ চায়। দ্বিতীয়ত, তাড়াহুড়ো করে কিছু করা সংগত হবে না আবার বেশি দেরি করাও চলবে না। তৃতীয়ত, ভাবনা-চিন্তা করে আপাতত যা প্রস্তুতি আছে তা দিয়ে কিছু একটা সাংগঠনিক রূপ দাঁড় করানো উচিত। অন্যথায় লোকেরা সংগঠিত হওয়ার কোনো উৎস পাবে না।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :