নুসরাতের হেরে যাওয়া এবং আমাদের দুঃখবোধ

অরুণ কুমার বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ১১ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:৩১

অবশেষে নুসরাত মারা গেলেন। নাকি তাকে খুন করা হল! কাউকে তঞ্চকতা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে তারপর গায়ে কেমিক্যাল ছুড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়াকে আপনি আর কী বলবেন! শুধু খুন নয়, ঠান্ডা মাথায় নৃশংসতম ও নিষ্ঠুরতম খুন।

অথচ তার অপরাধ কী ছিল! সিরাজ নামক এক নরপশুর লালসার কাছে স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে নিজেকে বিকিয়ে দিতে চায়নি, বরং ন্যূনতম সম্ভ্রমবোধটুকু নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল নুসরাত। এজন্য তাকে এমন চরম মূল্য চুকোতে হল! এই বুঝি আমাদের দেশে বহমান প্রবল উন্নয়নের জলোচ্ছ্বাসের নমুনা!

নুসরাত একজন ছাত্রী। তিনি পরীক্ষা দিতে গিয়ে ঘাতকদের বর্বরতার শিকার হন। তাই সঙ্গত কারণেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই কেসে পার্টি হতে পারে। আবার তিনি একজন মেয়ে, তাই অতি উৎসাহী কেউ কেউ নারীবাদের ধুয়ো তুলে ব্যাপারটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাইছে।

নুসরাত মেয়ে হোক বা ছাত্রী- সবার আগে তিনি একজন মানুষ। তাকে তার মৌলিক মানবিক অধিকারটুকু অটুট রেখে বেঁচে থাকবার নিশ্চয়তা দেবে রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্র তার নাগরিকের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হয়, তাকে আর যাই হোক, উন্নত রাষ্ট্র বলা চলে না। নুসরাতের মৃত্যু আমাদের শুধু হতবাক করেনি, করেছে বিভ্রান্তও। জন্ম দিয়েছে হাজারো প্রশ্নের।

অধ্যক্ষ সিরাজের এটাই প্রথম অপরাধ নয়। বরং নানা তথ্যসূত্রে জানা যায়, তিনি একজন পেশাদার নারীনিপীড়ক। সারাক্ষণ সে সুলুক-সন্ধান করতে থাকে, নরমসরম কাউকে পেলেই অমনি সে তার শিকারে পরিণত করে।

বস্তুত সিরাজের এই হায়েনাপনা কিন্তু লোকাল পুলিশের অজানা ছিল না। বরং সেখানে একরকম ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলেছে বলেই আমার বিশ্বাস। যেন কিছুই জানি না, কিছুই দেখিনি- এইরকম একটা ব্যাপার। আর সে কারণেই সিরাজের প্রভাববলয় আজ বড় বেশি বাড়বাড়ন্ত। ওরা কাউকে মানতে চায় না। সোমত্ত কাউকে দেখলেই অমনি তাদের নোলায় পানি গড়ায়। তারা ধর্ষকামী হয়ে ওঠে।

একশ্রেণির সুস্থদেহী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী আবার এই বলে ধুয়ো তুলছে যে, সব দোষ নুসরাতের। সে কেন নিজেকে সারাক্ষণ মমির মতো গায়েগতরে তেনা পেঁচিয়ে রাখেনি, বা কেন সে সুন্দরী হতে গেল। সিরাজরা আবার দেখতে শুনতে খুবসুরত নয়- এমন কারো দিকে তাকায় না। তাদের রুচিবোধ খুব প্রখর!

বিস্ময়ে হতবাক হই- যখন দেখি নুসরাতের বিষয়ে মাদ্রাসা প্রশাসন একেবারেই নীরব ভূমিকায় রয়েছে। যেন এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সেখানে ব্যক্তি-সিরাজ অপরাধ করেছে, তাই মাদ্রাসাসংশ্লিষ্ট কারো কিছু করবার নেই।

বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়- এই সিরাজ মূলত ক্ষমতার খুঁটি নিয়ে হাঁটে। এলাকায় তার রয়েছে বিশাল প্রভাব-প্রতিপত্তি। এ-কথাও কারো অবিদিত নয় যে, ক্ষমতাসীন দলের অনেকের সঙ্গেই তার দারুণ সখ্য। প্রায়ই তারা সিরাজের বাড়িতে দাওয়াত কবুল করেন ও আকণ্ঠ পান-ভক্ষণ করে থাকেন।

এই যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে সেখানে নুসরাতের মতো আপাতমস্তক ভদ্র একটি মেয়ে কীভাবে বেঁচে থাকে বলুন! তার তো মাস্তানটাইপ দুটো ভাই নেই যে ঠেঙিয়ে সিরাজের মতো লম্পটদের সোজা করে দেবে!

তবে মানুষ হিসেবে আমার বিস্ময় মাত্রা ছাড়ায়, যখন দেখি নুসরাতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু ছেলেমেয়ে সেই ধর্ষকামী সিরাজের পক্ষ নিয়ে মানববন্ধন করে। ওরা কি জানে, মানববন্ধন কাকে বলে! এভাবে অন্যায়ের পক্ষে রাস্তায় নেমে ওরা কার মানবতাবোধে সুড়সুড়ি দিচ্ছে?

ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ক্লিপে দেখলাম, সেখানে কিছু ছাত্রী সিরাজের পক্ষে সাফাই গাইছে এবং নুসরাতের চরিত্র নিয়ে গল্প তৈরির চেষ্টা করছে। ভাবতেও লজ্জা করে, মেয়ে হয়ে তারা কী করে তাদের সতীর্থের নামে এমন অভব্য গুজব রটায়!

নুসরাত আর আমাদের মাঝে নেই। তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, যারা নুসরাতের হন্তারক তারা যেন কঠোর শাস্তি পায়। আমরা আশাবাদী হতে চাই, কিন্তু একটু পেছনে ফিরে তাকালে আমাদের সেই আশাবাদ কিন্তু আর টেকে না। ফানুসের মতো ফুস করে নিমিষে মিলিয়ে যায়।

তনুর কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে! তাকে নিয়ে তো কম নাটক হয়নি! সবাই সবকিছু জানে এবং বোঝে। শুধু তনুর হত্যাকারীদের যাদের আইনের কাঠগড়ায় আনবার কথা, তারাই কিছু খুঁজে পান না বা বুঝতে পারেন না। কী আশ্চর্য ব্যাপার, তাই না!

আমরা হুজুগে জাতি, আমাদের বুকের ভেতর আবেগের মাতামাতির কিছু কমতি নেই। কিছু একটা হলেই আমরা অমনি যার যেমন খুশি প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করি। কিন্তু তার স্থায়িত্ব গোল্ডফিশের স্মৃতির চেয়েও কম। দুদিন যেতে না যেতেই সবকিছু বেমালুম ভুলে যাই। অবশ্য এর পেছনে কারণও আছে। বনানীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কেউ আর মনে রাখেনি। কারণ এর পরপরই ফায়ারম্যান সোহেল রানার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা সামনে এসে গেছে। আবার এখন নুসরাতের মৃত্যুতে বেচারা সোহেল রানা অনেকটাই ইতিহাস হয়ে যাবার অপেক্ষায় রয়েছে।

কেউ কেউ ভাবছেন, তনু বা নুসরাতের পর কে আসছে আবার! কার কপাল পুড়বে! এমন আশঙ্কা করা মোটেও অমূলক নয়। কেননা নিকট অতীতে চোখ ফেরালে আমরা দেখি- কোনো অঘটনেরই সমুচিত বিচার হয়নি। অপরাধীরা বরং তাদের আজন্মলালিত খুঁটির জোর খাটিয়ে কোনো না কোনোভাবে ঠিক বেরিয়ে এসেছে। পুলিশ তাদের টিকিটি অব্দি কেটে রাখতে পারেনি। এভাবে ওরা একের পর এক অপরাধ করার পরেও নির্বিচারে মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে আসার ফলে ওরা একরকম কৃত্রিম ইনডেমনিটি বা দুঃসাহস অর্জন করে ফেলেছে।

এর পেছনে সুস্পষ্ট কারণ- অপরাধ করেও দিব্যি পার পেয়ে যাওয়া। ওরা বুঝে গেছে, আইনের হাত ওদের হাতের কাছে কিছুই না! আমরা আইন মানি কারণ আইনের ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তি পেতে হয়। অবাক ব্যাপার এই, সিরাজরা সবরকম আইন-আদালতের উর্ধ্বে, ওরা কাউকেই আর ভয় পায় না, কারণ ওদের সেই ইনডেমনিটি আছে বা তৈরি হয়ে গেছে।

ফলে তনু-তাহিরা আর নুসরাতদের তালিকা দিন দিন আরো প্রলম্বিত হবে এই আশঙ্কাও অমূলক নয়। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কী হবে বলা কঠিন! মানুষের ওপর ক্রমশ মানুষের বিশ্বাস উঠে যাবে। শুধু তাই নয়, আইন-আদালতের সুবিচার প্রদানের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। তাতে মানুষ একসময় মরিয়া হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিলেও আশ্চর্য হবার উপায় থাকবে না। কারণ খালি পেটে যেমন ধর্ম হয় না, ঠিক তেমনি দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ যা কিছু করে ফেলতে পারে। তাই সময়ে কঠোর হওয়া সমীচীন। নইলে অচিরেই সমাজে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে বাধ্য।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অতিরিক্ত কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :