স্বাগত ১৪২৬ বঙ্গাব্দ

প্রকাশ | ১৩ এপ্রিল ২০১৯, ২৩:০৬

আরিফুর রহমান

বছর ঘুরে আবার এসেছে বৈশাখ। পুবাকাশে নতুন সূর্যের রক্তিম আভা বাঙালির হৃদয়ে ছড়িয়ে দেয় বর্ষবরণের রঙ। ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে’ প্রাণে প্রাণে অনুরণন তোলে নতুনের আবাহন।

‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির রূপময় বৈশাখকে আবাহন করেছিলেন। তারই ‘এসো এসো বৈশাখ এসো’ আবাহনে পুরনো বছরের সব গ্লানি, অপ্রাপ্তি, বেদনা ভুলে নব আনন্দে জাগবে গোটা জাতি।

আসলে এই আবাহনের সুর উঠেছে পুরনো বছরের শেষ চৈত্রদিনের সূর্য ডোবার পরই। চৈত্রসংক্রান্তির মধ্য দিয়ে বিদায় নিয়েছে ১৪২৫ বঙ্গাব্দ।

স্বাগত বাংলা নববর্ষ ১৪২৬। নতুন বছরের নতুন দিনে আমাদের পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, লেখক, শুভানুধ্যায়ীসহ সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।

আবহমানকাল ধরে আমরা দেখে আসছি- পহেলা বৈশাখ ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বাঙালির মিলন ঘটানোর দিন। এই নতুন দিন ঘিরে বাঙালির কত না রঙের আয়োজন। এসব আয়োজনে থাকে কাছে যাওয়ার, কাছে টানার নিখাদ বাঙালিয়ানা৷ কি গ্রাম কি শহর, গলি কিংবা রাজপথ, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ- সবখানেই সম্প্রীতির আবাহন।

বাংলার ঘরে ঘরে আজ সুখী আগামী দিনের আনন্দবারতা- নতুন পোশাক, ঐতিহ্যিক খাবার আর হৃদয়ে মঙ্গলবন্ধনা। তাই বাঙালির জীবনে সবচেয়ে আনন্দের দিন পহেলা বৈশাখ।

মাঠে মাঠে, নদীর পাড়ে, বটের তলায় প্রাণের বৈশাখী মেলা। নাগরদোলার ক্যা-ক্যু ছন্দ, বেলুনবাঁশির পো ধ্বনির দীর্ঘসুর, বাজে ডুগডুগি আর রঙিন ঢোলের বোল। মুড়ি-মুড়কি, মণ্ডা-মিঠাইয়ের ম-ম সুবাস; নাচে-গানে, ঢাকে-ঢোলে, পালাগানে উদার বিরাজ সবখানে।

নাগরিক জীবনে বিশাল বিশাল সব আয়োজন নিয়ে বৈশাখ-বন্দনা। মাটি আর বাউল গানের আসর। পহেলা বৈশাখের এক প্রধান স্মারক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ সবই আমাদের বাঙালি সত্তার গৌরব-মহিমায় সিক্ত করে।

এবারের পহেলা বৈশাখ আরেক বিশেষত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের সামনে। এখন এটি বিশ্ব সংস্কৃতিরও অংশ। জাতিসংঘের সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তাদের ‘রিপ্রেজেনটেটিভ লিস্ট অব ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় সারা দেশে আয়োজিত হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ইতিমধ্যে ইউনিয়ন পর্যায় পর‌্যন্ত বৈশাখ উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার আবহ পেল পহেলা বৈশাখ।

আমরা নতুন বছর বরণ করার সব আয়োজনের সাফল্য কামনা করি। একই সঙ্গে আশা করি পহেলা বৈশাখ উদযাপন যাতে নির্বিঘ্ন ও আনন্দপূর্ণ পরিবেশে উদযাপিত হয়, সে জন্য নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বঙ্গাব্দ চালুর সময় থেকেই পহেলা বৈশাখ একরকম রাষ্ট্রীয় (রাজকীয়) আচারের অংশ ছিল। সম্রাট আকবরের আমলে সর্বভারতে খাজনা আদায়ের জন্য এই নতুন বছরের সূচনা। হিজরি সন ও বাংলা পঞ্জিকার সমন্বয়ে 'বাংলা বছর'-এর প্রচলন করেন আকবর, যা 'ফসলি সন' নামে ১৫৮৪ সালের মার্চ মাসে প্রবর্তিত হয়। তখন থেকেই বৈশাখের প্রথম দিনটি উৎসবমুখরতায় উদযাপিত হয়ে আসছে।

পহেলা বৈশাখে বাঙালির আরেক ঐতিহ্যিক অনুষঙ্গ হালখাতাও চলে আসছে আকবরের আমল থেকে। এদিন ব্যবসায়ীরা তাদের খরিদ্দারদের দাওয়াত দিয়ে এনে মিষ্টিমুখ করান এবং পুরনো হিসাব চুকিয়ে লাল টালি খাতায় খোলেন নুতন হিসাব।

নতুন বছর আমাদের সম্প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় করুক, সবার জীবনে বয়ে আনুক সমৃদ্ধি ও মঙ্গল- এ কামনা করছি।

লেখক: সম্পাদক, ঢাকাটাইমস ও এই সময়।