রাবি শিক্ষক শফিউল খুনে তিনজনের ফাঁসি

প্রকাশ | ১৫ এপ্রিল ২০১৯, ১২:২৬ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:৫৪

রাজশাহী ব্যুরো, ঢাকাটাইমস
রাবি শিক্ষক শফিউল ইসলাম

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষক ড. একেএম শফিউল ইসলাম লিলন হত্যা মামলায় তিন আসামির ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। সোমবার বেলা ১২টার দিকে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক অনুপ কুমার সাহা জনাকীর্ণ আদালতে চাঞ্চল্যকর মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বেকসুর খালাস পেয়েছেন আটজন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, আবদুস সামাদ ওরফে পিন্টু (৩৪), আরিফুল ইসলাম ওরফে মানিক (৩৩) এবং মো. সবুজ (১৮)। তাদের মধ্যে পিন্টু রাবি ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি। তিনি নগরীর খোজাপুর এলাকার মোজাহার এলাকার ছেলে।

মানিক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কাটাখালি পৌর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি কাটাখালি এলাকার আশরাফ আলীর ছেলে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামি সবুজ বাখরাবাজ দক্ষিণপাড়া এলাকার শফিকুল ইসলামের ছেলে। এই তিনজনের মধ্যে সবুজ পলাতক আছেন। রায়ে বিচারক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করেছেন।

মামলার অভিযোগপত্রে দণ্ডপ্রাপ্ত পিন্টুর স্ত্রী নাসরিন আখতার রেশমাসহ মোট ১১ জন আসামি ছিলেন। রায় ঘোষণার সময় আসামি সবুজ ছাড়া সবাই আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর দণ্ডপ্রাপ্তদের রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। বিচার চলাকালে মামলায় মোট ৩৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।

রাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শফিউল ইসলাম লিলন লালন ভক্ত মুক্তমনা ও প্রগতিশীল আদর্শের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় তাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। বিকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মুহাম্মদ এন্তাজুল হক মতিহার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

ড. শফিউল খুনের ৫ ঘণ্টার মাথায় ফেসবুকে একটি পাতা খুলে দায় স্বীকার করে ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন। তাই উগ্রবাদী এই সংগঠনটি হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল। তবে তদন্তে বেরিয়ে আসে ব্যক্তিগত কোন্দলের জেরেই খুন হন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। আর এই কোন্দল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার নাসরিন আখতার রেশমার সঙ্গে।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ২৩ নভেম্বর প্রথমেই রেশমার স্বামী রাবি ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি আবদুস সামাদ পিন্টুসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে রেশমাকেও গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর হত্যাকাণ্ডের কারণ জানিয়ে রেশমা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

পরবর্তীতে রাজশাহী মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তৎকালীন পরিদর্শক রেজাউস সাদিক আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, রেশমার সঙ্গে ড. শফিউলের ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল। রেশমা এ বিষয়টি তার স্বামী পিন্টুকে জানান। পিন্টু এ বিষয়ে ড. শফিউলের সঙ্গে কথা বলতে যান। তখন ড. শফিউল তাকে অপমান করেন। এ কারণেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। মানিকের সঙ্গে আলোচনা করে পিন্টু হত্যার সব পরিকল্পনা করেন। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফেরার পথে শিক্ষক শফিউলকে কোপানো হয়।

অভিযোগপত্রের বর্ণনা অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সবুজ শিক্ষক ড. শফিউলের মাথায় প্রথম কোপটি দেন। মামলার এজাহারে কারও নাম উল্লেখ করা না হলেও সব আসামিকে খুঁজে পাওয়া যায় মামলার তদন্তকালে। এরপর তাদের অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, এমন আটজনকে মামলার অভিযোগপত্র থেকেই অব্যাহতি দেয়া হয়।

মামলার অভিযোগপত্রে ‘জামাই বাবু’ নামে পরিচিত এক ব্যক্তির এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা উঠে আসে। তবে তদন্তকালে পুলিশ তার আসল পরিচয় উৎঘাটন করতে পারেনি। মামলার রায়েও তার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। অভিযোগপত্রে জামাই বাবু সম্পর্কে বলা হয়, ‘ঘটনাটির সঙ্গে জড়িত আসামিদের সহযোগী তদন্তে প্রাপ্ত জামাই বাবু এর সঠিক নাম-ঠিকানা পাওয়া যায় নাই। ভবিষ্যতে তার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

মামলার রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহতের ছেলে সৌমিন শাহরিদ। তিনি বলেন, যারা সাজা পেলেন, তারা খুনি কি খুনি না সে বিষয়ে আমার কোনো মতামত নেই। তবে মামলার তদন্ত নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তদন্ত ঠিকমতো হয়নি। হত্যার সঠিক কারণ উঠে আসেনি।

জানতে চাইলে মামলার অভিযোগপত্র দাখিলকারক পরিদর্শক রেজাউস সাদিক বলেন, তিনি সঠিকভাবেই মামলার তদন্ত করেছিলেন। তদন্তে যা পেয়েছিলেন সেগুলোই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। ‘জামাই বাবু’ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার আগেও কয়েকজন মামলাটির তদন্ত করেন। তারা জামাই বাবুর প্রসঙ্গটা এনেছিলেন। তিনি পরবর্তীতে তার পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেননি। তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ হয়নি। এটা হলে জামাই বাবুকে খুঁজে পাওয়া যেত।

মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এন্তাজুল হক বাবু। তিনি বলেন, আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যে রায় আনতে পেরেছি তাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করার যে প্রবণতা আছে সেটা এ রায়ের মধ্যে দিয়ে কমে আসবে। খালাস পাওয়া আসামিদের সাজা চেয়ে আপিল করা হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে নেয়া হবে।

এদিকে আটজনের খালাস দেয়ায় সন্তোষ এবং তিনজনকে ফাঁসির আদেশ দেয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আসামিদের আইনজীবী গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, মামলায় যে আটজনকে খালাস দেয়া হয়েছে সে ব্যাপারে আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু যে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তা নিয়ে আমরা অসন্তুষ্ট। তিনি বলেন, পুলিশ বলেছে, তাদের কাছে আসামিরা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কিন্তু মামলার ৩৪ সাক্ষীর কেউই পুলিশের বক্তব্যকে সমর্থন করে বক্তব্য দেননি। তাই সাজাপ্রাপ্ত তিনজনের মধ্যে যে দুজন উপস্থিত আছেন তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল হবে।

ঢাকাটাইমস/১৫এপ্রিল/আরআর/এমআর