ঐতিহ্য

১০৮ সবজিতে বৈশাখী পাঁচন

প্রকাশ | ১৫ এপ্রিল ২০১৯, ১২:৫৬

ইমরান উজ-জামান

বাঙালির পয়লা বৈশাখের সঙ্গে সঙ্গে পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন জাতি বিভিন্নভাবে বছরের শুরুটা পালন করে। যেমন চাকমারা বিজু, মারমারা সাংরাই, ত্রিপুরারা বৈসু, তঞ্চঙ্গাদের বিযু। সব মিলিয়ে এক সঙ্গে বলা হয় বৈসাবি। রাঙামাটিতে বৈসাবিকে উপলক্ষ করে মেলার হাট বসে। র‌্যালি, জলকেলি, বলী খেলা আরো কত কি।

তবে রাঙামাটির জেলেপাড়ায় বসে ভিন্ন রকমের আয়োজন। নতুন এবং পুরোনো জেলেপাড়া মিলে চারদিকে পানি থই থই দুটি পাহারে দুটি গ্রাম। হিন্দু ধর্মের দুই গ্রামের অধিবাসীরা মৎস্যজীবী। তারা বৈশাখ মাসের প্রথম দিন পাঁচন উৎসব করে থাকেন। বাঙালির নববর্ষের আদলে পালিত হয় পাঁচন উৎসব। অনেকটা ঈদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। 

সকাল থেকেই পাড়ার বউ-ঝিরা ঘাটে ভিড় করে বড় হাঁড়ি বা গামলা নিয়ে। যার মধ্যে থাকে হরেক প্রকারের সবজি যা লেকের পানিতে পরিষ্কার করতে নিয়ে আসেন তারা। আর অন্য হাতে থাকে ছোট মাটির হাঁড়ি যার মধ্যে থাকে ফুল। এই ফুল স্থলে ফেলা যাবে না। তা হলে অনাচার হবে। ফেলতে হবে পানিতে। পূজার ফুল পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে, গোসল করে পবিত্র হয়ে তার পর পাঁচনের জন্য কাটা সবজিগুলো ধুয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরেন তারা। বাড়ি ফিরে শুরু হয় পাঁচন রান্নার কাজ। কথিত আছে ১০৮ প্রকারের সবজি দিয়ে একটা তরকারি রান্না করে যার নাম পাঁচন। ‘তবে ১০৮ প্রকারের তরকারি থাকে না। এত তরকারি পাবে কই। থাকে শসা, কাঁঠাল, করলা, টমেটো, বাঁধাকফি, সাদা আলু, লাল আলু, লতি, কচু আরো অনেক কিছু।’ বলেছিলেন রমণী বালা। 
ছোট ছোট মেহমানরা মহানন্দে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাঁচন খাচ্ছে। পাঁচন খাওয়া শেষ হলে খই, মুড়ি-মুড়কি পলিথিনে নিয়ে তারা বাড়ি ছাড়ছে। প্রত্যেকের হাতে একটি করে পলিথিনের পুটলি। পুটলিতে বাড়ি বাড়ি থেকে জমানো এসব মুড়ি-মুড়কি। আর ঘরে ঘরে চলছে দেবতাকে তুষ্ট করার নানা আয়োজন। নিতাই মালির ঘরে বসেছে কীর্তনের আসর। মধুবালা দেবী মন্দিরা হাতে তান ধরেছেন। আর প্রিয়বালা ১৬ রকমের ফল জড়ো করেছেন দেবতার সামনে। 

পূজা উপলক্ষে প্রত্যেক ঘরের দরজায় সুতায় বেঁধে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে কিছু ফুল। প্রায় সবই বনফুল যেমন বন্য ডুমুর, ঘাসফুল, জবা। জেলেপাড়ার পূজার বেদি কিন্তু খুবই সাধারণ। 

কোনো বাড়িতে একটা খুঁটির মাথায় কাঠের চার কোনাকৃতি ছোট করে ফুল দিয়ে চলে পূজা। কোথাও খুঁটির উপরে ড্রাম রেখে তার ভেতরে। কোথাও আবার শুধুই ঘরের সামনের খালি জায়গায় মাটির লেপে আলপনা এঁকে সেখানে প্লেটে পাঁচন আর পাশে ফুল রেখে চলে দেবতাকে তুষ্ট করার কাজ। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে দুই গ্রাম মিলে পাহাড়ের পাদদেশে সমতল জায়গায় ডেকোরেশন আনিয়ে সেখানে চলছে পূজার কাজ। তারা রক্ষাকালীর পূজার প্রস্তুতি নিচ্ছে। 
বড়রা সব ব্যস্ত কেন্দ্রীয় পূজা উৎসব সফল করার কাজে। এবারে অসুর বদে ব্যস্ত কালি গলায় তার শত অসুরের মুন্ডুর মালা আর পাশেই বীনা হাতে সরস্বতী।
বাড়ির বউ-ঝিরা ব্যস্ত পাঁচন রান্নায় আর মেহমানদারিতে। কেউ কেউ আবার রান্নাবান্নার কাজ শেষ করে এইমাত্র ঝিলের জলে নেমেছে গোসলে। কৃষ্ণকায় রোদে পোড়া পেটানো শরীর, পানিতে শরীরের সঙ্গে লেপটে থাকা কাপড় অন্যান্য রমনীয়তায় পেয়ে বসে। চোখ সরাতে কষ্ট হয়। এ এমনই এক দৃশ্য যা দেখে কামের উদ্রেগ হয় না, তার পরও চোখ সরানো দায়। 

আর গ্রামজুড়ে শিশু-কিশোরদের বসেছে মেলা। তারা মুসলমানদের ঈদের মতো এ বাড়ি ও বাড়ি যাচ্ছে, প্রতি ঘরেই সামান্য হলেও মুখে তুলে দিয়ে রওনা হচ্ছে পরের বাড়িতে। এই হলো পাঁচনের মেলা। পাঁচন উৎসবের দিন কিন্তু কোনো রকমের মাছ-মাংস খাওয়া যাবে না। 

(ঢাকাটাইমস/১৫এপ্রিল/এজেড)