এ যেন ‘মিয়ানমার সিনড্রোম’!

অরুণ কুমার বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৪৩

মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা যেন মিয়ানমার সিনড্রোমে ভুগছি। তার আগে আসুন জেনে নিই, মিয়ানমার সিনড্রোম আসলে কী! যেমন ধরুন, হ্যাঙ-করা কম্পিউটারের মতোই আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের মাঝে মাঝেই মনে হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপখানি আমাদের নয়, তাদের। বস্তুত, চেয়ে-চিন্তে খেতে খেতে বেচারা মিয়ানমার সরকারের এটা একরকম অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে যে, ইচ্ছে হলেই অন্যের জিনিসকে বা জায়গাকে নিজের বলে দাবি করা। এই যে ইচ্ছে হলেই ‘তুমি আমার’ টাইপ চাহিদা, একে আমরা আপাতত ‘মিয়ানমার সিনড্রোম’ বলে অভিহিত করতে পারি। ধরে নিন, এটা একটা নতুন রোগ, দুঃখজনক হলেও সত্য, এই রোগের যথোচিত এন্টিবায়োটিক এখনও আবিষ্কৃত হয়নি বলেই আমার অনুমান।

মনোবিদ্যায় একটা শব্দ আছে জানেন তো- যার নাম ক্লেপটোম্যানিয়া, অর্থাৎ না জেনেবুঝেই অন্যের জিনিস হাতসাফাই করার অভ্যস। একে অনবধানতাবশত চুরিও বলা যায়, বা চুরির অভ্যাস। মিয়ানমার সরকার প্রায়শ এমনটি করে থাকে। এই নিয়ে তিনবার তারা আমাদের দেশের সীমান্তে অবস্থিত টেকনাফের কাছে যে দ্বীপটি, সেটিকে তাদের নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। মামার বাড়ির আবদার যাকে বলে!

সেন্টমার্টিনের কথা থাক, এবার আরেকটু বাড়িয়ে ছড়িয়ে বলি। অবস্থা ক্রমশ এমন দাঁড়িয়েছে যে, মিয়ানমার সরকার এখন না আবার ঢাকা শহরকেই তাদের নিজেদের অংশ দাবি করে বসে। প্রশ্ন উঠতে পারে, হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন! কীভাবে!

কৌতূহলী জনতা ওদের বায়নাক্কা শুনে হয়তো তেড়েফুঁড়ে উঠবেন। কিন্তু ভায়া, দয়া করে একটু ভেবে বলবেন কি, ঢাকা শহরের অংশবিশেষ, সেই মিরপুরের আর কোনো অস্তিত্ব কি দেখতে পাচ্ছেন! কোথায় মিরপুর, কোথায় কী! সবই তো এখন জলমগ্ন সেন্টমার্টিনস দ্বীপ!

আরেকটু পরিষ্কার করে বলি, মিয়ানমার সিনড্রোমের হিসাবমতে অং সান সুচির সরকার এবার হয়তো মিরপুরকেও আরেকটা দ্বীপ মনে করে নিজের দেশ ভেবে বসবে! গত দুদিনের অকাল বর্ষণে মিরপুরের মতোন ঢাকা শহরের আরও অনেক জায়গা গভীর পানির তলায় তলিয়ে গেছে। ফলে যারা টুকটাক কূটনীতি জানেন এবং বোঝেন, তারা এই ভেবে শঙ্কিত হচ্ছেন যে, মিয়ানমার সিনড্রোমের রোগী অন্য কেউ হয়তো ঢাকার বুকে আচমকা থাবা বসাবে ভাবছে। এর থেকে উত্তরণ কী, বলুন তো!

আগে শুনতাম, নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। আর এখন দেখছি, নদী নেই, নদীর বদলে জলমগ্ন এক ডুবোশহর হয়ে উঠেছে আমাদের ঢাকা। বৃষ্টির পানির তলায় ঢেকে যাচ্ছে খোঁড়াখুঁড়ি, হাঁড়িকুড়ি সব। ফলে জনদুর্ভোগ কেবল বাড়ছে বললে ভুল হবে, জনতার যেনো এখন শিরে সংক্রান্তি অবস্থা।

ভুখা-নাঙ্গা বেকুব মিয়ানমার না হয় রোগের তাড়নায় ভুল ভাবছে বা ভুলভাল বকছে, কিন্তু আমাদের ওয়াসার এমন দুরবস্থা কেন! সিটি করপোরেশনের লোকজন কি সব জেগে ঘুমাচ্ছে, নাকি তাদের কুম্ভকর্ণের ঘুম। একবার শুলে আর তাদের উঠতে ইচ্ছে করে না!

অবশ্য শুধু মিয়ানমারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দেশের মধ্যেও এমন অনেক মানুষ ও সংস্থা গজিয়ে উঠেছে, যারা কিনা গোটা দেশটাকেই তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি বলে মনে করে। সেদিন কাঁচাবাজারে যাচ্ছিলাম। ফুটপাত দিয়ে হাঁটবো তার জো নেই। সেখানে চেয়ার টেবিল পেতে দিব্যি দোকান সাজিয়ে বসেছে একজন। খোঁজ নিয়ে জানলাম তিনি লোকাল নেতা, চামচা বা পাতি নেতা, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তার নিত্য ওঠাবসা। ফলে তার বিরুদ্ধে কেউ কিচ্ছু বলে না। কিছু বলতে গেলে উল্টো ঠুসা খাবার জোগাড়। যেহেতু সে পাতিনেতা, ফুটপাতে তার অধিকার বেশি। অর্থাৎ গায়ের জোরে সে এখন আরেক মিয়ানমার।

আবার শুধু মিরপুর বলে নয়, জলমগ্নতায় কাকরাইল, শান্তিবাগ কিংবা কচুক্ষেতও কিছু কম যায় না। দুফোঁটা বৃষ্টি পড়তে না পড়তেই সেখানে গভীর প্রশান্ত মহাসাগর বয়ে যায়। তখন উবারের পাশাপাশি কুবের মাঝির নিজস্ব লঞ্চ বা নৌসার্ভিস চালু হলে ভাল হয়। তাতে অন্তত রাস্তার মাঝে চোরা খানাখন্দে রিকশা উল্টে কারো ঠ্যাঙ ভাঙবে না।

এই যে বললাম অন্যের জিনিস নিজের মনে করে হাতিয়ে নেয়া, এ তো শুধু রোগ নয়, রীতিমতো উপদ্রব এখন। অন্যের জমি জাল দলিলে ক্রয়, ক্ষমতাবান তাই গায়ের জোরে কাউকে তার আবাসভূমি থেকে তুলে দেয়া, রাতের বেলা দুর্বল প্রতিবেশী ও সংখ্যালঘুকে ভয়ভীতি দেখিয়ে দেশছাড়া করার হুমকি, এসবই তো হচ্ছে এখন। অথচ যার দেখার কথা সে নির্বিকার। আরামসে বসে খৈনি ডলছে বা নাকে সর্ষে তেল দিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে মিছে মিয়ানমারকে দোষ দিয়ে লাভ কী! আগে নিজের দেশ ঠিক করুন, তারপর অন্যের কাঁধে দোষ চাপান।

সেদিন এক রিপোর্টে দেখলাম, এক লোক, সবাই তাকে পাগল জানে। কিন্তু আমি তো জানি, আপন বুঝ পাগলেও বোঝে। সেই ব্যাটা তার এক প্রতিবেশীর ধানি জমিনে দাঁড়িয়ে সমানে চেঁচাচ্ছে, জানস, এই জমির মালিক কেড! এই যে, এই বেডা! অবস্থা ক্রমশ এমন দাঁড়িয়েছে যে, পাগলেও এখন অন্যের জমি নিজের দাবি করে বসে থাকে। যার যতটুকু ক্ষমতা আছে, তারচে সে বেশি দেখায়। ক্ষমতা যেন কাজের জন্য নয়, ওটা দেখানোর জিনিস! যেন চকচকে অন্তর্বাস!

সে যাক, আবার গোড়াতেই ফিরে আসি। বিশ্বে চলছে এখন ‘মিয়ানমার সিনড্রোম’। সুযোগ পেলেই অমনি অন্যের জিনিস হাতসাফাই করে বসে থাকে। কী ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাহীন, কী যৌক্তিক বা অযৌক্তিক, নিজের মান-সম্ভ্রম সব বিকিয়ে দিয়ে অন্যের জিনিস নিজের করে পেতে যেনো কারো কুণ্ঠা নেই। কিন্তু এই অবস্থা তো চলতে দেয়া যায় না। তাই মিরপুরকে মিয়ানমার সরকার নিজের দ্বীপ দাবি করবার আগেই সেখানকার অযাচিত খোঁড়াখুঁড়ি সব বন্ধ করে তাকে জলমগ্নতার হাত থেকে বাঁচাতেই হবে। নয়তো জনগণের সুবিধার্থে উবারের ন্যায় সেখানে নৌপরিহনের জন্য কুবের সার্ভিস চালু করতে হবে।

অরুণ কুমার বিশ্বাস: কথাসাহিত্যিক

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :