নিয়ম ভেঙে আবার বাংলাদেশ ব্যাংকে ২৪১ নিয়োগ

রহমান আজিজ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ২০:৫৭ | প্রকাশিত : ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৮:৫৯
ফাইল ছবি

নিরাপত্তা প্রতিবেদন বা ভেরিফিকেশন শেষ হওয়ার আগেই আবারো অফিসার (জেনারেল) পদে ২৪১ জনকে বুধবার নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সহকারী পরিচালক (জেনারেল) ও অফিসার (ক্যাশ) পদে ৪০৬ জনকে নিয়োগ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ৩০ আগস্ট সহকারী পরিচালক (জেনারেল) পদে ১৮৩ জন ও ১১ সেপ্টেম্বর অফিসার (ক্যাশ) পদে ২২৩ জন নিয়োগ পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায় থাকা একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, এটি বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে।

ঢাকাটাইমসের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকে পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই ২৪১ জন অফিসার (জেনারেল) পদে যোগদান করেছেন। যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো একটি কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরুপ। আরও ২০০ জন কর্মকর্তার ভাইভা শেষ হয়েছে। তাদেরও পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই নিয়োগ হতে যাচ্ছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজ শুরুর পর তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। অফিসার ক্যাশের বেশির ভাগ কর্মকর্তার ভেরিফিকেশনই হয়েছে নিয়োগের পরে।

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রথম শ্রেণির এক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও পুলিশ ভেরিফিকেশনের কারণে চাকরি আটকে যাওয়া বেশ কয়েকজন বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়োগ পেয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এটি আইনবিরুদ্ধ কাজ, যা নিয়ে ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। কর্মকর্তারা বলেন, এই ব্যাংক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক। এখানে থাকে সংবেদনশীল বহু তথ্য। ফলে যারা কাজ করছেন, তারা বিশ্বস্ত কি না, এই বিষয়টি অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে নেওয়া উচিত ছিল আগেভাগেই। বরাবর তা-ই হয়ে এলেও এবার কেন অন্যথা হলো, সেটি বুঝতে পারছেন না কেউ।

অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ বছর আগেও পুলিশি প্রতিবেদন না পাওয়ায় বহুজনের নিয়োগ আটকে রেখেছিল। ২০১৪ সালে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন হাতে না পাওয়ায় সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয় দুই ধাপে।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের নিজের এবং স্বজনদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কারও বিরুদ্ধে অতীতের কোনো অপরাধে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে কি না, রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে কেউ জড়িত নন, এই বিষয়টি নিশ্চিতের পরই নিয়োগ দেওয়া হয় সরকারি চাকরিতে।

জানা যায়, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে চাকরিপ্রত্যাশী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার নিয়ম রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রণীত কেপিআই নিরাপত্তা নীতিমালা ২০১৩-এর ৫.৩.১ ধারা অনুযায়ী, বিশেষ শ্রেণির কেপিআইয়ে নিয়োজিত সব সামরিক ও বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রাথমিক নিরাপত্তা প্রতিপালন করতে হবে। এ ছাড়া ডিজিএফআই, এনএসআই ও এসবির মাধ্যমে ছয় মাস অন্তর তাদের নিরাপত্তা ভেটিং করাতে হবে।

সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) অধীনে যত চাকরি আছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা সংস্থার ভেরিফিকেশনের পাশাপাশি চালু হয়েছে ইউএনও ভেরিফিকেশন। রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কেপিআই হলে কড়াকড়ি আরও বেশি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক কেপিআইভুক্ত প্রথম (ক) শ্রেণির প্রতিষ্ঠান হয়েও এই বিষয়টি উপেক্ষা করে নিয়োগ দিয়েছে।

বিশেষ করে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টির পর এমন ঘটনায় অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। ওই ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল।

সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমার নিয়োগ হওয়ার আগেই পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে। চাকরি স্থায়ী হওয়ার জন্যও ভেরিফিকেশন শেষ হয়েছে। তবে যতটুকু জানি, অনেকের ভেরিফিকেশন কাগজ নিয়োগের পরে এসেছে। যদিও তাদের নিয়োগ আগে হয়ে গেছে।’

ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার আগে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ (এফআরটিএমডি) ও ফরেন এক্সচেঞ্জের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় দায়িত্ব পালন করছেন।

অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি আবুল কাশেম নামে এক ক্যাশ অফিসারকে বরখাস্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেছেন ছয় মাস। এরপর তার পুলিশি রিপোর্ট খারাপ হওয়ায় চাকরি গেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর যেখানে সবদিকে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, সেখানে পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া নিয়োগ কীভাবে হলো, এটা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। সামনে যদি এটা চলতে থাকে, তাহলে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’

অন্য একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ দুই ব্যাচ হঠাৎ করে পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া নিয়োগ হয়েছে, যা আমাদের ব্যাংকের নিজস্ব নিয়ম ও কেপিআই নিয়মেরও পরিপন্থী।’

ভেরিফিকেশন ছাড়া নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের নিয়োগ অনুবিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মজিবর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া কারও নিয়োগ চূড়ান্ত করার সুযোগ নেই। তবে এমনটা হতেও পারে। কিন্তু ওভারঅল আমাদের সবার ভেরিফিকেশন কমপ্লিট।’

নিয়োগের পর ভেরিফিকেশনের নিয়ম আছে কি না, এমন প্রশ্নে মজিবর বলেন, ‘একটা সময় নিয়োগের পর পুলিশ ভেরিফিকেশন হতো। মাঝে একটা সিদ্ধান্ত মোটামুটি হয়, যেহেতু নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অনেক লম্বা সময় লাগে। তাই আমরা আগে ছেড়ে দেব, পরে পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে। যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে ওকে। তবে আমাদের এখন পর্যন্ত যত নিয়োগ হয়েছে, কোনোটাই পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া নেই।’

এই নিয়োগে তাড়াহুড়ো করারও তথ্য মিলেছে। অন্যান্য ব্যাচের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পর ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ পেতে আট থেকে নয় মাস সময় লাগে। তবে এই ব্যাচে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে।

গুঞ্জন আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরের নিকটাত্মীয় পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমার জায়গা থেকে এটা নিয়ে বলা মুশকিল। তবে ম্যানেজমেন্ট চাইলে সম্ভব।’

কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠানে এমন নিয়োগ হলে তা ঝুঁকি তৈরি করবে কি নাÑএমন প্রশ্নে জামাল বলেন, ‘অবশ্যই এটা ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। তবে এ বিষয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী আমরা যখন ছিলাম, তখন পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হওয়ার পরে নিয়োগ দেওয়া হতো। কাউকে ভেরিফিকেশন ছাড়া নিয়োগ দেওয়া হতো না। কিন্তু এখন বলা হয়েছে, নিয়োগের পর করা হয়েছে, সেহেতু এটা নিয়ে কথা বলা দরকার নেই। তবে সামনে এটা করা ঠিক হবে না।’

‘যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আছে, তাই নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগের আগে ভেরিফিকেশন শেষ করা উচিত হবে বলে মনে করি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। যদি এমনটা হয়েও থাকে, তাতে তিনি কোনো সমস্যা দেখছেন না।

ঢাকা টাইমসকে সিরাজুল বলেন, ‘আমি এখনো পর্যন্ত কনফার্ম, এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে ধরে নিলাম আপনার কথা সত্য। তবে এতে সমস্যা কিছু দেখি না।’

‘কারণ এমনও রেকর্ড আছে যে পুলিশ ভেরিফিকেশন করতে ছয় মাস থেকে এক বছর লেগে যায়। তাই পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য আমরা বসে থাকতে পারি না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যাদের বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অপরাধের রেকর্ড আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আবার যদি নিয়োগের পর কারো পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড বা কোনো অপরাধের তথ্য পাওয়া যায়, তখন তাদের বাদ দিয়ে থাকি। এটা নিয়োগের আগেই তাদের শর্ত দেওয়া আছে।’

(ঢাকাটাইমস/১৭এপ্রিল/আরএ/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :