নবীনগরে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা

আতঙ্কে পুরুষ-তরুণীরা গ্রামছাড়া, ক্ষেতে ঝরছে ধান

প্রকাশ | ২১ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৩৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের থানারকান্দি গ্রাম। গ্রেপ্তার আতঙ্কে শত শত লোক পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নৌকার সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট সমানতালে চলছে। যুবতী-তরুণীদের পাঠানো হয়েছে অন্যত্র।

জমির পাকা ধান কাটতে না পারায় জমিতেই ঝরে নষ্ট হচ্ছে। দাঙ্গা বন্ধে গ্রামে বসানো হয়েছে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। তারপরও থেমে নেই ভাঙচুর আর লুটপাট।

জানা যায়, গত ৩১ মার্চ উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী হন দোয়াত-কলম প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনির। পরদিন তার সমর্থক উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান আর নৌকার সমর্থক কাউসার মোল্লার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে কাউসার মোল্লার সমর্থকদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ করা হয়।

সংঘর্ষের ঘটনায় নবীনগর থানার এসআই জসিম উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাত ১২০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এরপর থেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কাউসার মোল্লার সমর্থকরা। তাদের অভিযোগ, নৌকার নির্বাচন করায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক জিল্লুর রহমানের লোকজন তাদের ওপর হামলা চালিয়ে বাড়িঘরে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। গ্রামছাড়া করা হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান ও তার লোকজন এসব ঘটনার নেতৃত্ব দেয়। পুলিশও তাদের হয়ে হয়রানি করছে।

গত ১৮ দিন ধরে থানাকান্দি গ্রামের শত শত লোক বাড়িছাড়া। গ্রামের নারী ও শিশুরা সন্ধ্যার পর আতঙ্কে থাকে হামলা আর লুটপাটের ভয়ে। জমির পাকা ধান কাটতে পারছে না কাউসার মোল্লার সমর্থকরা। ধান কাটার জন্য চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমানকে এক হাজার টাকা দিয়ে কাগজে তার স্বাক্ষর নিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কমপক্ষে ৫০টি বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িঘর দেখা গেছে। ঘরের আসবাবপত্র ভেঙে ফেলা হয়েছে।

সপ্তাহ দুয়েক আগেই ফসলি মাঠের ধান পেকে কাটার উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু পাকা ফসল কাটতে বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায় সরেজমিনে। জমিতে ধানের শীষগুলো মাটিতে নুয়ে পড়ে ধান ঝরে পড়ছে। শত শত কানি জমির ধান নষ্ট হওয়ার পথে। পুলিশের ভয়ে ধান কাটার শ্রমিকরা চড়া মূল্যেও গ্রামে আসতে রাজি হচ্ছে না।

থানাকান্দি গ্রামের হেনা বেগম বলেন, ‘রাতে বাড়িতে থাকতে পারি না। মেয়েদের অন্যত্র সরিয়ে রেখেছি। পুলিশও হুমকি দিতেছে ধরে নিয়ে যাবে। মেরে ফেলবে। ছেলের বিদেশে যাওয়ার টাকাও লুট হয়েছে।’

পার্শ্ববর্তী বড়াইল ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ফসল প্রক্রিয়া করছেন গ্রামছাড়া আনোয়ারা বেগম। তিনি জানান, চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর নিয়ে জমির ধান কাটতে হয়। কানিপিছু ১ হাজার টাকা দিতে হয়। চেয়ারম্যান জিল্লুর আর তার ভাই-ভাতিজারা বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে ঘরে আগুন দিয়েছে।

১৮ দিন ধরে তিনি বাড়িছাড়া জানিয়ে আনোয়ারা বেগম বলেন, তার বাড়ি  ছাড়াও মোস্তাকিম, হোসেন, খোকন, স্বপন ও জহির মিয়ার বাড়ি ও দোকানে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে।

থানাকান্দি ছাড়াও উত্তর লক্ষ্মীপুর, সাতঘরহাটি ও গৌরনগর গ্রাম অশান্ত নির্বাচনোত্তর এই বিরোধে। বৃদ্ধ আসাদ আলী বলেন, ‘পুলিশের ভয়ে তার চার ছেলের কেউই বাড়িতে নেই। পাকা ধান কাটতে পারছি না। কিছুদিনের মধ্যে নদীর জোয়ারে সব ধান পানিতে তলিয়ে যাবে।’

বৃদ্ধা মজলিশ বেগম জানান, চেয়ারম্যানের লোকজন বাড়িতে ঢুকে লাঠি দিয়ে মেরেছে। ঘর ভাঙচুর করেছে।

আরেক বৃদ্ধ আক্তার মিয়া বলেন, ‘নৌকার নির্বাচন করায় জিল্লুর চেয়ারম্যান ও তার লোকজন হামলা চালায়।’

কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জিল্লুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

লোকজনকে হয়রানির করা কিংবা কারও পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ নাকচ করে থানাকান্দি গ্রামে পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা এসআই কামাল হোসেন বলেন, ‘পরবর্তী দাঙ্গা এড়াতে সার্বক্ষণিক নজর রাখছি আমরা।’

নবীনগর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) রাজু আহমেদ জানান, পুলিশ নৌকা বা দোয়াত কলম কারো পক্ষেই পক্ষপাতিত্ব করে কাউকে ধরছে না। যারা দাঙ্গায় লিপ্ত ছিল তদন্ত করে তাদেরই ধরা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষের ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ঢাকাটাইমস/২১এপ্রিল/মোআ