ডাক্তার নিজেই যখন জানলেন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত

প্রকাশ | ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ১১:১৭

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকা টাইমস

অনেক রোগীর চিকিৎসা নিজ হাতে করেছেন তিনি। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের বহু অপারেশন করেছেন তিনি। কিন্তু নিজের যে এমন রোগ হতে পারে সেটি কখনো মনে করেননি লিয ও’রিয়ারডান। তিনি জানান, ‘অন্য অনেক নারীর মতো, আমি নিজের স্তন পরীক্ষা করে দেখিনি। আমি ভেবেছিলাম আমার ক্ষেত্রে এটা ঘটতে যাচ্ছে না-আমি একজন স্তন ক্যান্সার সার্জন’।

স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ার পর তার পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। ২০১৫ সালে ৪০ বছর বয়সে তাকে মাস্টেক্টমি করতে হয় (অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্তন অপসারণ) এবং গত মে মাসে এই রোগের পুনরাবির্ভাব ঘটায় ভুগতে হয়েছে।

ডক্টর ও’রিয়ারডান ভেবেছিলেন তিনি কুড়ি বছর ধরে সার্জন হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন কিন্তু কেবল দুয়েক বছর কাজ করতে পেরেছেন তিনি। ক্যান্সারের দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ তার কাঁধের নাড়া-চাড়াতে বাধাগ্রস্ত করে এবং মানসিকভাবে ভীষণ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।

ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার আগে ও’রিয়ারডান চাকার মতো অনুভব করেন এবং সেটি সিস্ট এর দিকে যাচ্ছিল, যেখানে মাত্র ছয়মাস আগের এক মোমোগ্রাম রিপোর্টে তার স্তন সম্পূর্ণ সুস্থ বলে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু আরেকটি চাকার পিণ্ড তৈরি হলে তার মার অনুরোধে তিনি স্ক্যানিং এর মধ্য দিয়ে যান। সাফোকের এই বাসিন্দা জানতেন তার দ্রুত আরোগ্যের জন্য কি চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রথমে সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং নানারকম প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরতে থাকে।

তিনি বলেন, ‘আমি স্ক্যান দেখেছি এবং জানতাম আমার স্তন অপসারণ করে ফেলতে হবে, এটাও জানাতাম আমার সম্ভবত কেমোথেরাপি প্রয়োজন হবে কারণ আমি বয়সে তরুণ ছিলাম এবং আমার দশ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটা সে সম্পর্কেও ভালো ধারনা ছিল এবং সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে মাথার মধ্যে এতসব চিন্তার ঘুরপাক খাচ্ছিল’।

তার মাথায় দুশ্চিন্তা ভর করে ‘কিভাবে স্বামীর সঙ্গে এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করবেন তা নিয়ে। একজন ক্যান্সার সার্জন হিসেবে নিজের পথচলা থামিয়ে দিয়ে কেবলমাত্র একজন রোগী হিসেবে পরিণত হওয়া কতটা সম্ভব?’

যদিও সে নিজেই জানতো ক্যান্সার আক্রান্তের শরীরের ভেতরে কী ঘটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার অভিজ্ঞতা কতটা ভয়াবহ সে সম্পর্কে তা তো কোন ধারণা ছিলনা।

তার কথায়, ‘কারো ব্রেস্ট ক্যান্সার আছে এটা তাদের বলা যে কেমন- তা আমি জানি। কিন্তু আমি জানতাম না যে ঠোঁট চেপে, চোখের জল লুকানো, ক্লিনিক থেকে বেরোনো, অপেক্ষা-গার পেরিয়ে, হাসপাতাল করিডর পেরিয়ে গাড়ি পর্যন্ত কোনরকমে পৌঁছানো এবং তারপর হাউমাউ করে কান্না।’

স্বামী ডার্মটের সঙ্গে আলাপ করার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় নিজের ১৫০০ টুইটার ফলোয়ারের মাঝে বিষয়টি ঘোষণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, যারা তাকে পছন্দ করত বেকিং, ট্রায়াথলন এবং তার পেশার জন্য।।

ও’রিয়ারডান জানান, ‘কিভাবে ক্যান্সারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে সেটা আমাকে বললো স্বয়ং আমার রোগীরা। যখন আপনি উচ্চমাত্রায় স্টেরয়েড নিচ্ছেন তখন ভোররাত তিনটার সময়েও কেউ একজন জেগে আছে আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য’।

ক্যান্সার আক্রান্ত আরও যারা চিকিৎসা পেশা সংক্রান্ত ব্যক্তিরা আছেন তাদের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যম তাকে যুক্ত রাখে এবং এরপর থেকে এই রোগের চিকিৎসকদের নিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলেন।

তার ক্যান্সারের প্রথম দফা চিকিৎসা শেষে ডক্টর ও’রিয়ারডান সার্জন হিসেবে ইপসউইচ হাসপাতালে কাজে ফিরে যান। তিনি জানান যে, তিনি অনুধাবন করতে পারেননি যে এটা ইমোশনালি কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে।

তিনি ভেবেছিলেন ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি হয়তো লোকজনকে ভিন্নভাবে সহায়তা করতে পারবেন। তিনি জানান, ‘এটা ছিল আমার দ্বারা সবচেয়ে কঠিন কাজ। যখন আপনি কাউকে একটি খারাপ খবর জানাচ্ছেন এবং কোনো নারীকে বলছেন যে তাদের শরীরে ক্যান্সার রয়েছে, এটা যেকোনভাবেই খুবই কঠিন। কিন্তু আমি স্মরণ করতে পারি যখন আমরা খবরটা শুনছিলাম এবং প্রচণ্ড কাঁপছিলাম তখন আমাকে এবং আমার স্বামীকে কেমন দেখাচ্ছিল তা আমি পরিষ্কার দেখতে পাই। আপনাকে এমন কারো সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে যারা একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে-কিন্তু আমি পারিনি কারণ তারা ছিল আমারই রোগী’।

তিনি বলেন, ‘আমার মাস্টেক্টমির পর প্রচণ্ড ব্যথা এবং মাঝে মাঝে অপারেশন করছিলাম। কারণ আমি খুবই সতর্ক ছিলাম এই ভেবে যে আমি হয়ত তাদের ব্যথার কারণ হবো যেটা আমার আছে এবং সে কারণে আমি সার্জারি করতে চাচ্ছিলাম না্ এটা ছিল খুব খুব কঠিন’।

২০১৮ সালে ও’রিয়ারডানের ক্যান্সার আবার ফিরে আসে। প্রচণ্ড ব্যথার কারণে তার পুনর্গঠিত স্তন অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেয়ার আগ দিয়ে করা এক স্ক্যানে তা ধরা পড়ে। এর ফলে একই জায়গায় দ্বিতীয় ডোজ রেডিওথেরাপি দেয়া হয়।

তাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল যে পরবর্তীতে সে হয়ত তার বাহু ঠিকভাবে নাড়াচাড়া করতে পারবে না- কিন্তু যদি সে সার্জারি না করত, তাহলে তার ফলাফল হতো শূন্য। আর চূড়ান্ত পরিণতি হয়েছিল আরও ক্ষতিকর। নরম টিস্যুগুলির ফাইব্রোসিস এবং টিথারিং তার কাঁধের নড়াচড়া কমিয়ে করে দেয় এবং তার বাহুর শক্তি কমে যায়।

তিনি জানান, দ্বিতীয়বারের মতো তার ক্যারিয়ার এগিয়ে নেয়ার জন্য সব ধরনের সহায়তার চেষ্টা করেছেন নিয়োগ-দাতা। আমি ইনটেনসিভ ফিজিওথেরাপি নিয়েছি, একজন অর্থোপেডিক সার্জনের সঙ্গে দেখা করি কারণ আমার অনেককিছু বলার ছিল। আমার জীবনের ২০ বছর যে কাজে আমি সময় দিয়েছি, ডিগ্রী এবং পিএইচডি, পরীক্ষার পর পরীক্ষা এবং নিজের প্রিয় বিষয়ে একজন সুদক্ষ পেশাজীবী হওয়ার জন্য বিভিন্ন কোর্স-সবকিছুর পরও সেটা আমি আবার সে কাজটি করতে পারছি না।

দৈনন্দিন জীবনের সব কাজ করতে পারছিলাম কিন্তু নিরাপদে অস্ত্রোপচার- সেটি আর কখনোই হচ্ছে না। আগের চেয়ে এখন ক্যান্সার ফিরে আসার ঝুঁকি আরও বেশি। মজার ব্যাপার হলো, সে এখন ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার পর লোকজন যেন কাজে ফিরে যেতে পারে সে বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।

তার স্বামী একজন কনসাল্ট্যান্ট সার্জন। ও’রিয়ারডান বলেন তিনি যথেষ্ট সৌভাগ্যের অধিকারী যে তার সচ্ছলতা রয়েছে এবং বেতনভোগী হিসেবে কাজ করতে হয় না। সম্প্রতি তিনি সামাজিক উদ্যোগ ওয়ার্কিং উইথ ক্যান্সারের একজন স্বেচ্ছাসেবী অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন। ২০১৭ সালে কাজে ফেরার সময় তাকে উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছে তারা।

তবে নানারকম শারীরিক জটিলতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাকে- ‘আমি এখনও খুব ক্লান্তিতে ভুগি এবং আমার মস্তিষ্ককে আবারও কাজে ফেরানোর চেষ্টা করছি’।

নিজ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘আমি আগে কখনো বুঝতে পারিনি যে কারো ক্যান্সার হলে তাহলে আপনাকে আইনগত-ভাবে অক্ষম হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হবে ইকুয়ালিটি অ্যাক্ট অনুসারে এবং আপনার নিয়োগ-দাতাকে আপনাকে কাজে ফেরানোর জন্য যুক্তিসঙ্গত সমন্বয় সাধন করতে হবে।’

বহু মানুষ ক্যান্সার ধরা পড়ার পর তাদের জীবন ফিরে পেতে মরীয়া হয়ে ওঠে, কিন্তু সঠিক উপায় খুঁজে বের করা অকল্পনীয় কঠিন হতে পারে এবং অনেক নিয়োগ কর্তৃপক্ষ জানে না কিভাবে ক্যান্সার পেশেন্টকে সাহায্য করতে পারে বা কি করা উচিত।

তিনি জানান ওয়ার্কিং উইথ ক্যান্সারের বেশিরভাগ প্রশিক্ষকের শরীরে ক্যান্সার রয়েছে এবং তারা জানে অধিকার সম্পর্কে এবং কর্মী এবং নিয়োগ-দাতাদের তারা তৈরি করে। একজন পরামর্শক হিসেবে প্রতিবছর শত নারীকে স্তন ক্যান্সার বিষয়ে সচেতন করছেন চিকিৎসক ও’রিয়ারডান।

তিনি বলেন, ‘আমার বই, ব্লগ, বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় এবং অ্যাম্বাসেডর হিসেবে শত শত, হাজার হাজার নারীকে সাহায্য করতে পারি’। সূত্র: বিবিসি

ঢাকা টাইমস/২৩এপ্রিল/একে