জাতির পিতার কাছে বাবা

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
| আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:২৪ | প্রকাশিত : ২৪ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:৩৮

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিমত পোষণ করা উচিত নয়। অতীতে এই মহান নেতাকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত হয়েছে এবং এখনো একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা চলছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করে না, বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে যারা স্বীকার করতে চায় না, বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু বলতে যারা দ্বিধাবোধ করে, বাংলাদেশের এই মহান নেতাকে যারা শ্রদ্ধা করে না, যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করে তাদের বেলায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করার প্রশ্ন আসতে পারেl

আমি আজ বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে অনেক দূরেl আমাদের পরিবার বর্তমানে দেশে বিদেশে। পরিবারের ছোট ভাই কবিরুল ইজদানী খান বর্তমানে যুগ্ম সচিব হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে এখন আর কেউ সক্রিয় নয়। ছিলাম শুধু আমি। এখন আর নেই। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একচ্ছত্র ও মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চিরন্তর হয়ে থাকবেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া বাঙালি জাতির এই মহান নেতাকে দল মত নির্বিশেষে সকলকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা উচিতl বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিমত থাকা উচিত নয়l বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এই দুটি নাম একে ওপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের জনগণের একক শ্লোগান হতে হবে এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ। এই শ্লোগান পঁচাত্তরের জানুয়ারিতে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ থেকে আমরা প্রথম দিয়েছিলাম।

আমার বাবা আলী মেহেদী খান কোনোদিন রাজনীতি করেননি, ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। বাহাত্তরের শেষের দিকে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তৃপক্ষ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে বাবাকে বদলি করা হয়। তিনি তার এই দায়িত্ব ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা রাত্রি পর্যন্ত পালন করেন। আমার বাবার দৃষ্টিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। শুধু তাই নয় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি তার আদর্শ হলেও তিনি ছিলেন মনে প্রাণে একজন প্রকৃত মুসলমান।

বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। প্রতিদিন সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে প্রথমে রমনার গণভবনে ও পরবর্তিতে শেরে বাংলা নগরের গণভবনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এইসময় বঙ্গবন্ধুর কালো মার্সেডিজের সামনের সিটে বসতেন বাবা। দিনের কর্মসূচি শেষে আবার রাতে বাসায় পৌঁছে দিতেন। বাকি সময়টা বাবার ডিউটি গণভবনে থাকতো। গাড়িতে বসে বঙ্গবন্ধু অনেক কিছুই খোলামেলা আলাপ করতেন। বাবা আজ আর নেই। ২০০২ তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। বাবা বেচে থাকতে তার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে শোনা কথা থেকেই আমার এই লেখা।

প্রথমেই নির্বাচন নিয়ে শুরু করা যাকl আমাদের পরিবারের সকলেই সবসময় নৌকায় ভোট দিয়ে আসছে। ২০০১ ছিল বাবার দেওয়া শেষ ভোট। আমার ছোট ভাই কল্যাণপুর স্কুলের ভোট সেন্টারে ভোট দেওয়ার জন্য বাবাকে নিয়ে যায়। ভোট দেওয়ার সময় বাবা ভাইকে বলেন, কামাল মজুমদারের নামটা কোথায়। কারণ আজকের মন্ত্রী কামাল মজুমদার ও আমি একইসাথে একসময় ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। বাবা ভোটের কাগজ হাতে নিয়ে ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, কামাল কোনটা? ভাই দেখিয়ে দিলে বাবা কামাল মজুমদারকে ভোট দেন। ভোট দিয়ে ছোট ভাইকে বলেন, আমি নামাজ পড়বো বলেই নামাজের প্রস্তুতি নিতে গেলে ছোট ভাই কবিরুল বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, বাবা এটা মসজিদ নয় এটা ভোট সেন্টার। না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার মাত্র একবৎসর পূর্বে বাবা তার শেষ ভোট দিয়েছিলেন নৌকায়l বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার অসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিলl আমার ছাত্র জীবনের রাজনৈতিক সাথী বন্ধু কামাল মজুমদারের সাথে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেখা হলে ঘটনাটা বলেছিলাম।

যার যার ধর্ম তার তার। অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষতা। এই নীতিতে বিশ্বাস করার জন্য ওইসময় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বঙ্গবন্ধুকে ইসলামবিরোধী ব্যক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করে। অথচ বাস্তব হলো স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামকে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি রাশিয়াতে অনুষ্ঠিত তাবলীগে বাংলাদেশ থেকে জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। ঢাকার কাকরাইলের মসজিদের জন্য জমি বরাদ্দ করেন। বিশ্ব এজতেমার জন্য টঙ্গীতে সরকারি জায়গা বরাদ্দ দেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে পবিত্র হজ্জ পালনের জন্য বিমান ভাড়া করাসহ সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করেন। ঢাকার সোবানবাগ মসজিদের উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ করেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনে যোগদান করে মুসলিম বিশ্বে ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমন একজন ইসলাম প্রিয় মহান ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধবাদীরা মিথ্যা অপপ্রচার ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। ঠিক এখন যেমন করছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।

একদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডি বাসার বারান্দায় একটি ইজিচেয়ারে বসে তসবিহ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। এইসময় বঙ্গমাতা বাবাকে খাবারের জন্য বঙ্গবন্ধুকে ডেকে আনার কথা বলেন। বাবা বারান্দায় এসে দেখেন ক্লান্ত নেতা গভীরভাবে ঘুমিয়ে আছেন। এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে ডাকার সাহস বাবার হলো না। কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সরাসরি না ডেকে তিনি একটু কাশি দিলেন। আর তাতেই নেতা জেগে উঠলেন। বাবা বঙ্গবন্ধুকে বললেন খাওয়ার জন্য আপনাকে ভেতরে যেতে বলেছেন। বঙ্গবন্ধু উঠে ভেতরে চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর পড়নে তখন লুঙ্গি ও গেঞ্জি। কৌতুহলী বাবা ইজিচেয়ারে বঙ্গবন্ধুর তসবিটি হাতে নিয়ে আশ্চর্য হলেন। আমরা সাধারণত যে তসবি পড়ে থাকি তার সংখ্যা ১০০ হলেও বঙ্গবন্ধুর পড়া তসবির সংখ্যা ছিল ১০০০, সুবহানআল্লাহ। বাঙালি জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু কত ধর্মপ্রাণ ছিলেন একবার ভেবে দেখুন। তবে তিনি কখনই ধর্মকে সামনে টেনে আনতেন না। কারণ তিনি ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করতেন।

বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে শেরে বাংলা নগর গণভবনে যেতেন। বাবা তখন নেতার গাড়ির সামনের আসনে বসতেন। একদিন সকালে গণভবনে যাওয়ার পথে সোবানবাগ মসজিদ ক্রস করার সময় বঙ্গবন্ধু বাবাকে বললেন, এই মসজিদটির এত করুন অবস্থা কেন? আপনি একটু খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাবেন। বাবা যেন আকাশে চাঁদ পেলেন। কারণ এই মসজিদে তিনি নিজেও নামাজ পড়েন। আমরা তখন থাকতাম সোবানবাগ সরকারি কলোনিতে। আমরা ছাড়াও এই সময় এই কলোনিতে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোটো বোনের জামাই সৈয়দ সৈয়দউদ্দিন। এই সৈয়দ সৈয়দউদ্দিনের মেয়ে রোজির সাথেই বিয়ে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র লে. শেখ জামালের। তিনি তখন ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব।

বঙ্গবন্ধুর কথা অনুযায়ী বাবা পরবর্তিতে সোবানবাগ মসজিদ কমিটির তৎকালীন সেক্রেটারি বাবার ঘনিষ্ট বন্ধু শ্রদ্ধেয় সহিদুল হক চাচার সাথে যোগাযোগ করেন। বাবা ও সহিদুল হক চাচা খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। তিনি তখন এ জি বিতে চাকরি করতেন ও বাস করতেন ঠিক সোবানবাগ মসজিদের উল্টোদিকের একটি গলিতে। বাবা সহিদুল হক চাচার সাথে কথা বলে মসজিদের সকল সমস্যার কথা জেনে নিলেন। পরে একদিন বঙ্গবন্ধুকে সোবাহানবাগ মসজিদের অবস্থা জানালে বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণাৎ মসজিদ উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আজ যারা এই মসজিদে দৈনন্দিন নামাজ পড়েন এবং মসজিদ কমিটির তত্ত্বাবধায়ক জানিনা নেতার এই অবদানের কথা তাদের কারো জানা আছে কি না। আজকের সোবানবাগ মসজিদের যে উন্নতি তার শুরুটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অনুদান। এই মসজিদ যার অবস্থা ৭৪ সালে ছিল ভাঙা দেয়াল আর পুরানো টিনের চাল। আর আজ কত বড় উন্নতি হয়েছে। মসজিদ ঘিরে কয়েকটি দোকানও খোলা হয়েছে। দুঃসময়ে সোবানবাগ মসজিদের করুন অবস্থা থেকে আজকের উন্নতির পথে নিয়ে আসতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।

লেখক: গ্রূপ লিডার সুইডিশ লেফট পার্টি স্টকহলম হেঁসেলবি ভেলেংবি লোকাল কাউন্সিল

নির্বাচিত সদস্য মনোনয়ন বোর্ড সুইডিশ লেফট পার্টি সেন্ট্রাল কমিটি, জুরি স্টকহলম আপিল কোর্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :