সিলেটে বহুতল হাসপাতাল নির্মাণে চলছে প্রত্ন নিদর্শন গুঁড়িয়ে দেয়ার পাঁয়তারা

প্রকাশ | ২৬ এপ্রিল ২০১৯, ১৬:১১

আফরোজা সোমা

সিলেটে প্রায় পৌনে দু’শো বছরের পুরনো ও ঐতিহাসিক একটি প্রত্ন নিদর্শনকে ভেঙে-গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে আধুনিক বহুতল হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ চূড়ান্ত করা হয়েছে।

এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে সিলেটের স্থপতি, নগর-পরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজ। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রত্ন সম্পদকে রক্ষা করতে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে আসাম রীতিতে নির্মিত দুর্লভ এই ভবনটি বর্তমানে আবু সিনা ছাত্রাবাস নামে পরিচিত।

ঐতিহাসিক এই ভবনটিকে না ভেঙে এটিকে সংরক্ষণের জোর দাবী ওঠেছে।

দুর্লভ এই প্রত্ন সম্পদকে রক্ষার স্বার্থে, এখনো নির্মাণ কাজ শুরু না-হওয়া প্রকল্পাধীন হাসপাতালটিকে সিলেট শহরের অন্যত্র সরিয়ে নিতে দাবী জানিয়েছে সিলেটের স্থপতি, নগর-পরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজ।

কিন্তু বাংলাদদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটসহ সিলেটের স্থপতি, নগর-পরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজের দাবীকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ঐতিহাসিক এই ভবন ভাঙার তোড়জোড় চলছে।

জানা গেছে, ভবনটিকে ডেমোলিশ বা ধ্বংস করার জন্য ২৮ লাখ টাকার একটি টেন্ডার বা দরপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন সিলেটে চর্চারত স্থপতি ও নগর-পরিকল্পনাবিদরা।

ভবনের ইতিহাস

আবু সিনা ছাত্রাবাস নামে পরিচিত ভবনটি আনুমানিক ১৮৫০ সালের দিকে নির্মিত হয়। প্রায় পৌনে দু’শো বছরের পুরনো এই স্থাপনাটি শুরুতে ছিল ব্রিটিশ মিশনারিদের স্থাপিত বৃহত্তর সিলেটের প্রথম মেডিকেল স্কুল।

১৮৭৬ সালে এই ভবন থেকেই প্রকাশিত হয় সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’।

দুই মহাযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত স্থাপনা এটি। ১ম বিশ্বযুদ্ধে সেনা ছাউনি হিসেবে ভবনটি ব্যবহৃত হয়েছে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি ছিল ব্রিটিশ সেনাদের মেডিকেল ক্যাম্প।

১৯৭১-এর রক্তস্নাত ইতিহাসের সাথেও রয়েছে এই স্থাপনার স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকসেনারা এই ভবনটিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ৭১-এ এই হাসপাতাল চত্বরেই হত্যা করা হয় ডা: শামসুদ্দীন এবং ড. শ্যামল কান্তি’র মতন মুক্তিকামীদের।

পাকিস্তান আমলেও এটি ছিল মেডিকেল হাসপাতাল। পরবর্তীতে, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হলে ভবনটি মেডিকেলের ছাত্রদের আবাসিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে এবং আবু সিনা ছাত্রাবাস হিসেবে পরিচিতি পায়। গত কয়েক মাস আগেও এখানে ছাত্রবাস ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে। ওসমানী মেডিকেলের ছাত্রদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে নিজস্ব ভবনে।

আর এখন এই ঐতিহাসিক ভবনটিকে ভাঙতে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এনেছে হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ।

ভবনের নির্মাণশৈলী

প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই ভবনের নির্মাণশৈলীতে রয়েছে তিনটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। ভবনের নকশায় একইসাথে যোগ হয়েছে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রীতি, আসামের নিজস্ব ধারার নির্মাণশৈলী এবং বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি।

অর্থাৎ ব্রিটিশ নির্মাণশৈলীর এই ভবনে যোগ হয়েছে আসাম রীতিতে গড়া ঢালু টিনের ছাদ। এই টিনেরো রয়েছে কিছু নিজস্বতা। পানি নিষ্কাশনে রয়েছে এর অনন্য ব্যবস্থা। আসাম প্যাটার্নের ঢালু চালের সাথে এই ভবনে রয়েছে বায়ু চলাচলের জন্য নির্মিত টাওয়ার। এই টাওয়ার বা চূড়াগুলোর অপূর্ব সমন্বয় এই ভবনের আরেকটি অনন্য ও বিরল বৈশিষ্ট্য। এই রীতির ভবনের ক্ষেত্রে এই স্থাপত্যের তুল্য আর কোনো ভবন বাংলাদেশে নেই।

ভবনের মাঝখানে রয়েছে আয়াতাকার একটি ইন্টারনাল ওপেন কোর্ট বা অভ্যন্তরীন একটি খোলা মাঠ।

এই ইন্টারনাল ওপেন কোর্ট বা অভ্যন্তরীন খোলা মাঠটি বাংলার চিরায়ত উঠোন সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই নকশায় এসেছে বলে উল্লেখ করেছেন সিলেটে দীর্ঘদিন ধরে স্থাপত্য চর্চায় জড়িত এবং সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের নকশাকার স্থপতি রাজন দাস।

বাঙালী সংস্কৃতির মিশেলে আসাম রীতিতে গড়া এমন আরেকটি ঔপনিবেশিক ভবন বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর বলে এটিতে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করেন তিনি।

কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই ভবনটিকে বাংলাদেশের স্থাপত্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে কনজারভেশান বা সংরক্ষণ না করে উল্টো এটিকে বিনষ্টের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় প্রত্ন-নিদর্শন হিসেবে  ভবনটিকে রক্ষায় সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছেন সিলেটের স্থপতি, নগর-পরিকল্পনাবিদ এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্য সচেতন নাগরিক সমাজ।  

উল্লেখ্য, কেউই হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে নন। সকলেই চান, হাসপাতালটি নির্মাণ হোক। কিন্তু তাদের মূল দাবী হচ্ছে, প্রকল্পাধীন এই হাসপাতাল নির্মাণ করতে গিয়ে যেনো দুর্লভ প্রত্ন সম্পদ ও স্থাপত্যের ইতিহাসকে মুছে দেয়া না হয়।

তাই, হাসপাতালটিকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবী করা হচ্ছে।

এই ভবন নিয়ে আমি কেন লিখছি?

আবু সিনা ছাত্রাবাসটিকে যেনো গুঁড়িয়ে দেয়া না হয় সেজন্য সাংবাদিকতাসূত্রে আমার সাথে পরিচিতদের এই প্রত্ন সম্পদ বিনষ্টের খবরটি যেনো যথাসম্ভব অবহিত করি সেই বিষয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন স্থপতি রাজন দাস ও স্থপতি শওকত জাহান চৌধুরী।  

কারণ তারা মনে করছেন, ঐতিহাসিক এই প্রত্ন-নিদর্শনটি গুঁড়িয়ে দেবার আগেই যদি ঢাকায় যারা ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় সক্রিয় আছেন তারা যদি এই ভবন ভাঙার ঘটনটাটি জানতে পারেন তাহলে তারা এগিয়ে আসবেন এবং হয়তো রক্ষা পাবে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অনন্য ভবন।

ঐতিহাসিক এই গুরুত্বপূর্ণ ভবনটির বিষয়ে দুই স্থপতির কাছে শুনে এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে জেনে আমি নিজেও এই ভবন সুরক্ষায় প্রয়োজনীয়তার কথা জনসমক্ষে তুলে ধরতে তাগিদ বোধ করেছি।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বহুমূল্য দিয়ে সংরক্ষণ করে রাখার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু আমাদের দেশে ঐতিহ্যকে রক্ষার ক্ষেত্রে কেন এতো অনাদর, অবহেলা ও উদাসীনতা তার উত্তর পাওয়া কঠিণ।

হাসপাতালটি হওয়া নি:সন্দেহে জরুরি প্রয়োজন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, হাসপাতাল বানাতে গিয়ে প্রত্ন সম্পদ ধ্বংস করতে হবে কেন? হাসাপাতালটি নির্মাণ করার জন্য সিলেট শহরে উপযুক্ত জায়গা আরো বহু পাওয়া যাবে। কিন্তু এই ভবনটি যদি একবার মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয় কোনো মূল্যেই কি তা আর ফেরত পাওয়া যাবে?