রোমে একদিন...

কমরেড খোন্দকার, রোম থেকে
 | প্রকাশিত : ২৬ এপ্রিল ২০১৯, ২৩:০৮

‘রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন এ ডে’ অর্থাৎ রোম একদিনে নির্মিত হয়নি। তেমনি রোম শহর একদিনে ঘুরে দেখাও সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ইতালিতে বসবাস করলেও রোম সেভাবে দেখা হয়নি। তারপরেও ব্যর্থ চেষ্টা। পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রোম শহর ঘুরে দেখতে। সাথে রোমের সাংবাদিক নুরুল আলম জনি।

অনেকদিন আগের কথা। যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় সাড়ে ৭শ’ বছর আগে থেকে রোম নগরীর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার কথা জানা যায় একটি লোককথার গল্পে।

রোমুলাজ ও রেমুজ দুই যমজ ভাই ছিল। শিশুকালেই পিতা-মাতা একটি ঝুড়িতে করে তাদের তাইবার নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে এক বনের ধারে গিয়ে ভিড়ল ঝুড়িটি। সেখানে কোনো মানুষের বাস নেই। চারদিকে গভীর বন। বাঘ-ভালুকের মতো হিংস্র প্রাণিরা বাস করে সে বনে। একদিকে নদীতে ভাসমান ঝুড়ির ভেতরে কাঁদছে অবুঝ দুটি শিশু- অপরদিকে নদীর পানি খেতে বন থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি নেকড়ে। শিশু দুটির কান্না শুনে মা নেকড়ের মনে দয়া হলো। সে ভাবল, আমিও তো মা। আমারও সন্তান আছে। গভীর জঙ্গলে রেখে তাদের জন্যে খাবারের খোঁজে বেরিয়েছি। তারাও তো কোনোদিন এমন বিপদে পড়তে পারে। দেখা গেল, পথ ভুলে কোথাও চলে গেছে। আমাকে আর খুঁজে পাচ্ছে না। কেমন কষ্ট পাবে আমার সন্তানেরা! মা নেকড়ে ছেলে দুটি নিয়ে গেল তার গুহায়। মাকে দেখে নেকড়ের বাচ্চারা ছুটে এলো কাছে। বুকের দুধ পান করল। ওদের দেখাদেখি ছেলে দুটিও নেকড়ের দুধ খাওয়া শুরু করল। মাও কিছু বলল না। বাচ্চারাও না। এভাবে কয়েকদিন রাখল সঙ্গে সঙ্গে। একদিন এক রাখাল দেখল, দুটি ছেলে নেকড়ের সঙ্গে খেলছে। তার বুকের দুধ খাচ্ছে। নেকড়ের কাছ থেকে ছেলে দুটি উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে গেল রাখাল। দিন গেল। বছর গেল। রোমুলাজ ও রেমুজ বড় হলো। একদিন জানল তাদের কুড়িয়ে পাওয়ার কথা। এ ঘটনাকে তারা স্মরণীয় করে রাখতে চাইল। এজন্যে নির্মাণ করতে চাইল সুন্দর একটি নগরী। কিন্তু দুই ভাইয়ের মধ্যে দেখা দিল মতবিরোধ। এক ভাই চাইল নদীর পাশেই নির্মাণ করবে এ শহর। এ নদী থেকে নেকড়ে যদি তাদের তুলে না আনত, তাহলে তারা হয়ত মারাই যেত। আরেক ভাই বলল, নদীর তীরে নয় নগর প্রতিষ্ঠিত হবে সবুজ বনের ভেতর যেখানে নিয়ে নেকড়ে তাদের দুধ পান করিয়েছে। এ নিয়ে যমজ দুই ভাইয়ের মধ্যে শুরু হলো হাতাহাতি, এরপর অস্ত্রের লড়াই। এ লড়াইয়ে রেমুজ খুন হলো রোমুলাজের হাতে। নিজের পছন্দ মতো জায়গায় সে প্রতিষ্ঠা করল একটি নগরী। নাম দিল রোম। সময়টি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সাল।

এটি একটি গল্প। অনেকদিন থেকে রোম নগরী প্রতিষ্ঠার ইতিহাস হিসেবে এ গল্পটি চলে আসছে। আসলে রোমের উত্থানের পেছনে রয়েছে অনেক মজার ঘটনা। তাইবার নদীর উপকূলে রয়েছে সাতটি পাহাড়। এসব পাহাড়ে বাস করত নানা জাতির মানুষ। তারা পেশায় ছিল কৃষক। জমি চাষ করত। নানারকম ফসল ফলাত। সেজন্যে দরকার হতো পানি। ছোট্ট এ নদীটিই একমাত্র ভরসা। সবাই নদী থেকে পানি সেচে ফসলের ক্ষেতে দেয়। ফলে পানি কমে গিয়ে মানুষের বেশ অসুবিধে হতে থাকে। তাই ছোট্ট ছোট্ট দলে বিভক্ত হয়ে আলাদা বসতি স্থাপন শুরু করল। এতে শক্তির দিক দিয়ে তারা দুর্বল হয়ে পড়ল এবং নানা রকম শত্রুর আক্রমণে বারবার পরাজিত হতে থাকল। লোকেরা অনুমান করল তাদের ভুল হয়েছে। আজ যদি তারা কষ্ট করে হলেও একত্রে বাস করত, তাহলে কেউ তাদের ক্ষতি করতে পারত না। তাই আবার তারা একত্রে বসতি স্থাপন করতে ফিরে এল। এবার তারা খাল খনন করে জলাবদ্ধতা দূর করল। ডোবা শুকিয়ে অধিক জমিতে ফসলের চাষ করল। কয়েক বছরের মধ্যে সেখানে আগের মতো আবার সোনার ফসল ফলতে শুরু করল। তাইবার নদীর তীরে একের পর গড়ে উঠল নতুন নতুন ইমারত। রোমুলাজ এবং রেমুজের যে উপকথা শোনা যায় তার সঙ্গে সত্যের বেশ পার্থক্য দেখা যায়।

আরেক সূত্র থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে পশ্চিম ইতালির একটি এলাকার নাম ছিল লেতিয়াম। এখানেই জন্ম নিয়েছিল দুই যমজ ভাই রোমুলাজ ও রেমুজ। ইতরুসকান এবং স্যাবাইন জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা বাস করত এখানে। এটি ছিল সমতলভূমি। লেতিয়ামের এ সবুজ সমতল ভূমি থেকে একদল লোক প্রথম রোমে বসতি স্থাপন করতে আসে। এরা বিভিন্ন পেশায় বেশ দক্ষ ছিল। কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে জানত। এখানে এসে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা খুবই লাভবান হলো এবং প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে গেল। প্রতিবেশীদের কাছে মনে হলো, আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো। রোমানদের এ দ্রুত উন্নতির জন্যে অনেকের কাছে তারা চোখের কাঁটা হয়ে হয়ে গেল। ইতরুসকান ও সামনিতরা তো সহ্যই করতে পারল না। রোমানদের সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়ল যুদ্ধে। আর তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে রোমান শাসকরা বারবার বৃদ্ধি করতে থাকে সেনাবাহিনী।

একদিকে দক্ষ এ সেনাবাহিনী তাদের শহরের নিরাপত্তা দিতে লাগল, অন্যদিকে একের পর এর নতুন নতুন এলাকা দখল করে নিল। এভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালে রোমানরা নিয়ন্ত্রণে নিল ইতালির অধিকাংশ এলাকা।

আমার ভ্রমণের দিনের শুরু মহিলা সমাজকল্যাণ সংস্থার বৈশাখী মেলা দিয়ে। স্থানীয় একটি পার্কে নারী পুরুষের দেশীয় সাজে মনে হলো প্রবাসের বুকে ছোট একটি বাংলাদেশ। তারপর যাত্রা শুরু হলো কলোসিয়ামের দিকে। বিখ্যাত কলোসিয়ামের ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে যেন শুনে নেয়ার চেষ্টা করছিলাম সিংহের গর্জন, গ্ল্যাডিয়েটরের হুঙ্কার। কান পেতে শুনতে চাইছিলাম ঐতিহাসিক চরিত্রদের নিঃশ্বাসের শব্দ, ফিসফাস, ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ। রাজকীয় অহংকারের প্রতীকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অহং বোধকে যেন একটু তাঁতিয়ে নিচ্ছিলাম।

ছেলেবেলায় ইতিহাস বিষয়টাকে খুব নীরস বলে মনে হতো, ভয় পেতাম। আজ যেন ইতিহাস বইয়ের পাতার জীবন্ত নিদর্শনের সামনে দাঁড়িয়েছি। আজ আর ভয় নয়, সমীহ হচ্ছে। ইতিহাসের নিদর্শন বুকে নিয়ে অতীত ও বর্তমান দিন বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজকের এই আধুনিক রোম।

প্রতিদিন হয়তো কয়েক কোটি ছবি তোলা হয় এই কলোসিয়ামের, পৃথিবীর কত কোটি মানুষের ঘরে যে কলোসিয়ামের সঙ্গে ওঠানো নিজের বাঁধানো ছবি আছে তার ইয়ত্তা নেই।

তাই তাড়াতাড়ি কলোসিয়ামের মোহ কাটিয়ে রোমের অন্য দিক আবিষ্কারের উদ্দ্যেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম।

রোমের পরিবেশে এখনো যেন ভাসে পুরনো গন্ধ, পুরনো রহস্য। পথে দেখি অতীতের রোমান ফরুম পুরনো রোমের কেন্দ্র ছিল এই জায়গা।

যা কিছু ব্যবসা বাণিজ্য, রাজ্য বিস্তার সবই ছিল এখানে। এখন এক ধ্বংসাবশেষ, উঁচু উঁচু কিছু থাম আর অনেক দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ। রোমে আমার মনে হয়, ইতিহাসের উপস্থিতির চেয়েও অনুভব বেশি। রোমান সাম্রাজ্যের অহং, উত্থান ও পতন, সৃষ্টি ও ধ্বংসের যা কিছু নিদর্শন সবই এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মানুষের শক্তির চেয়েও বেশি মহাশক্তিমান কালের শক্তি অনুভূত হয় রোমে।

শহরের একদম মধ্যে আছে পিয়াছা ভেনিসিয়া। বিশাল এই স্থাপত্য ঘিরে এই শহরের প্রাণকেন্দ্র। কত নতুন ও পুরনো সিনেমায় যে এই জায়গার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, তার কোন হিসাব নেই। এখানে আশেপাশে আরও অনেক ঐতিহাসিক বিল্ডিং আছে। যেমন উত্তর দিকে আছে নেপোলিয়ানের মায়ের বাড়ি, পালাচ্ছো বনোপারতে, তাছাড়া আছে আঠারো শতকের বিল্ডিং পালাছেত্তো ভেনিসিয়া। এখানে এই শহরের ব্যস্ততা অন্যান্য আর পাঁচটা শহরের মতোই। ইস্টারের ছুটিতে প্রচুর টুরিস্ট এখানে। শীত কাটিয়ে একটু একটু করে গরম পড়তে শুরু করেছে। একটু একটু করে রোমের অবগুণ্ঠন খুলছে আমাদের সামনে। এবার চলে এলাম ট্রেভি ফোন্তানা।

ট্রেভি ফোন্তানা এর মধ্যে নেপচুন– সমুদ্র দেবতার মূর্তি, দু’পাশে সমুদ্র ঘোড়া– সমুদ্রের জোয়ার ভাটার প্রতীক। এখানে পয়সা ফেলার রেওয়াজ।

ট্রেভি ফোন্তানার সামনে যে রাস্তা চলে গেছে সেই রাস্তা ধরে চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম রোমান মন্দির রোমান প্যাথেটন। ভিড়, সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার গাড়ি। এগিয়ে চললাম এখনো অনেক দেখার বাকি। এর মধ্যেই আমাদের সাথে যোগ দিলেন প্রবাসী সাংবাদিক অল ইউরোপিয়ান বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির।

এবার চলে এলাম পিয়াছা স্পানিয়া বা স্পানিয়া স্টেপ। আঠারো শতকে তৈরি এই সিঁড়ি পিনসিও হিলের উপরে ফ্রেঞ্চ চার্চ তিরিনিতা ডেই মন্তি কে জুড়েছে। প্রতিবছর গরমের সময় এই সিঁড়িতে ফ্যাশন শো হয়। এই স্পানিয়া স্টেপের রাস্তায় প্রচুর দোকান। আর দোকানগুলো সব বিশ্বের দামি দামি ব্যান্ডের।

শেষ বিকালে চলে গেলাম পিয়াছা ডেল পপোলোর দিকে। এইদিকে সন্ধ্যার এই সময়ে বিশেষ টুরিস্ট নেই, নির্জন এই ধ্বংসাবশেষে যখন সূর্যের শেষ বেলার আলো নিভে আসছিল, ধীরে ধীরে ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষে আঁধার ঘনিয়ে আসছিল...!! এবার হোটেলে ফেরার পালা। বাকি রইল ভ্যাটিকান সিটি...!!

লেখক: ইউরোপ ব্যুরো প্রধান, ঢাকাটাইমস

সংবাদটি শেয়ার করুন

প্রবাসের খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

প্রবাসের খবর এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :