অতি লোভে তাঁতি নষ্ট!

অরুণ কুমার বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ২৯ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৫৮

সেই সোনার ডিমপাড়া হাঁসের কথা আমরা কে না জানি। বাস্তবে কোনোদিন কোনো হাঁস সোনার ডিম না দিলেও গল্পের হাঁসি স্বর্ণডিম্ব প্রসব করতেই পারে। সোনার ডিমটা তো আসলে বড় কথা নয়, কথা হল এই- বেশি লোভ করলে তার ফল মোটেও ভালো হয় না। নিত্যদিন চলার পথে আমরা এমন অনেক নজির দেখতে পাই যাতে নিঃসন্দেহে প্রমাণ করা যায় যে, অতিরিক্ত লোভের ফলে আমাদের অনেকের সুদাসল দুটোই মাঠে মারা যায়।

প্রসঙ্গত আমরা বর্ষীয়ান অভিনেতা আবুল হায়াৎ এবং হাসির রাজাখ্যাত চঞ্চল চৌধুরীর সেই পাঞ্জাবি কেনার টিভিসি’র কথা উল্লেখ করতে পারি। চঞ্চল খালি সস্তা খোঁজে, এই নিয়ে তার স্ত্রীর মনের ব্যাপক দুঃখ। সস্তার যে তিন অবস্থা, এই সহজ সরল কথাটুকুই চঞ্চল বুঝতে পারেন না। তিনি তিনশ টাকায় পাঞ্জাবি কিনে রামধরা খান। এক ধোয়ায় পাঞ্জাবির সব রঙ উঠে গিয়ে মুখে মাখে, কাপড় কুঁচকে অর্ধেক হয়, সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড!

এই যে আমাদের সীমাহীন লোভ, এতে কি কেবল মানহানি হয়, প্রাণহানি কি ঘটে না। ঘটে। আলবাত ঘটে। এই তো সেদিন পত্রিকান্তরে জানতে পারলাম, দুই হতভাগা, হ্যাঁ, আমি হতভাগাই বলবো এদের। দিব্যি চাষবাস করে খাচ্ছিল। হয়তো তারা নিত্যদিন মাছ-মাংস জোটাতে পারতো না, শাক-সুক্তো দিয়েই চারটে ভাত মেখে খেতো। কিন্তু খেতে তো পারতো, নাকি। দিন তাদের ভালই যাচ্ছিল। কিন্তু সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় বলে একটা কথা আছে না! দুই হতভাগা চাষার হঠাৎ মনে হল, তাদের রাতারাতি ধনী হতে হবে। তাদের টাকা চাই, অঢেল টাকা। টাকার বালিশে মাথা রেখে শুতে হবে। যেন টাকার বালিশে মাথা দিলে ঘুম বেশি পায়, আর নির্ভেজাল ঘুম হয়! সেই জন্য নাকে সর্ষেতেলও মাখতে হয় না।

এক ইয়াবা কারবারির পাল্লায় পড়ে হতভাগা চাষা পেটের ভিতরে করে ইয়াবা পাচার শুরু করে। বাসে বা কাভার্ডভ্যানে ইদানীং কড়া তল্লাশি চলছে, তাই তারা পাকস্থলিতে করে ইয়াবা আনছে ঢাকায়। কয়েকবার বেশ সাফল্যের সঙ্গে কাজটা তারা করতে পারলো। বিনিময়ে পেলো কড়কড়ে নোট। টাকার চাকায় ভর করে তাদের সুখের রেলগাড়ি দ্রুতগতিতে ছুটতে লাগলো। তাতে তাদের লোভ আরো বেড়ে গেলো। এবার তারা অতিরিক্ত পরিমাণে ইয়াবা ঢোকালো পেটে। ফলে কী হলো! ইয়াবা বড়ি গলে মিশে গেলো রক্তে। বিষক্রিয়ায় তারা মারা গেলো। লাশের ময়নাতদন্ত শেষে তাদের পেটে পাওয়া গেলো কয়েক হাজার ইয়াবা বড়ি। চাষার সুখ সেখানেই শেষ। তারা ধনেপ্রাণে মারা পড়লো। পথে বসলো তাদের পরিবার।

চাষার কথা থাক, এবার আসুন ভদ্দরনোকের কথা বলি। কেসটা বোধ করি আপনাদের কারো অজানা নয়। সেই যে ফরিদপুরে, মেলা টাকার মালিক এক ঠিকাদার। টাকার গোলা তার এতই চওড়া যে, একমাত্র ছেলে যখন যা চায়, চাহিবামাত্র তা কিনে না দেয়া অব্দি তার ঘুম হয় না। এক্ষেত্রে ছেলের মা আবার আরো এককাঠি উপরে। বড়লোকের ছেলে বলে কথা, ছেলের আব্দার আহ্লাদ মেটাতে না পারলে তারা কিসের মা-বাবা! আত্মীয়-স্বজনের কাছে তাদের প্রেস্টিজ থাকে?

ছেলে একের পর এক দামি মোবাইল, স্মার্টফোন এসব চাইতে থাকে। বাবা কিনে দেন। ওদিকে ছেলে যে ক্রমশ উচ্ছন্নে যাচ্ছে, সে খেয়াল কারো নেই। কারণ বাপ তার টাকার পেছনে ছোটে, ছেলেকে দেখার তার সময় কই! সে তো টাকা বানাবার মেশিন। শেষে ছেলে তার দামি মোটরবাইক চাইলো। আড়াই লাখ টাকা দাম। টাকার কারবারি বাপ শুরুতে খানিক গাঁইগুঁই করলেও শেষে একমাত্র ছেলের মুখ চেয়ে বাইক কিনে দেবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু ছেলের তার অত ধৈর্য কই! সে চাহিবামাত্র বাইক না পেয়ে রাগে দুঃখে একরাতে বাপ-মা দুজনকেই ঘুমের ঘরে দিলো আগুন। বাবা-মা পুড়ে অঙ্গার! আহা রে, টাকা! টাকার খই ফুটছে এখন বাবা-মায়ের লাশের উপর।

ব্যাটা ব্যাংকার। আগে ছিল কেরানি, মেলা দেনদরবার করে শেষে একখানা ব্যাংকের চাকরি জোগাড় করলো। চাকরি তার তেমন আহামরি কিছু নয়, প্রাইভেট ব্যাংকের ক্যাশে কাজ করে। তবে খুব চালিয়াত যেহেতু, খুব তাড়াতাড়ি বসের নেক নজর পড়ে তার উপর। বস বুঝলেন, একে দিয়েই হবে। তার অর্থের লোভ প্রবল। গরিব সে ঠিক আছে, কিন্তু চিত্তসুখের সে কিছু বোঝে না। তার শুধু টাকা চাই, টাকা।

কথায় বলে, যে যা চায়, স্রষ্টা তাকে তাই দেন। ক্যাশিয়ারের কপালেও টাকা জুটলো। সোজা পথে কি আর হয়! বসের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সে চেক জালিয়াতি শুরু করে। অন্যের অ্যাকাউন্টের টাকা তুলে নেয়। মাস গেলে তার মেলা টাকা উপরি থাকে। সে ফ্ল্যাটের বুকিং দেয়। এভাবেই কচুপাতা কেটে কেটে একদিন মস্তবড় ডাকাত হয় ক্যাশিয়ার। জ্যামিতিক হারে তার লোভ বাড়ে। নাহ, টুকটাক খেয়ে আর তার পোষায় না। একদিন সে নিজেই বস হয়ে ওঠে। যাকে বলে মুষিক থেকে সিংহ। বসকে ব্ল্যাকমেল করে সে প্রচুর টাকা কামায়। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি বসেরও বস থাকে। অবশেষে একদিন ধরা খায় সে। পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়, ফলে অ্যারেস্ট হয়ে সোজা জেলে। টাকাকড়ি সব তো গেলই, মাঝখান থেকে বউ তারে তালাক দিয়ে চলে যায় অন্য ঘরে। চোরের সঙ্গে কে ঘর করে বলুন!

এবার এক অভিজ্ঞতার কথা বলি। নামধাম জানানো যাবে না, তাতে সমূহ বিপদ। আমারই চেনাশোনা একজন। ছোট পরিবারের ছেলে। লক্ষ্য করবেন, যারা খুব গরিব ঘর থেকে আসে, টাকার প্রতি তাদের লোভটাও থাকে বেশি। আগে কখনও পায়নি তো, একবার বাগে পেলে চোক চোক করে টাকা চুষে খায়!

তো সেই ছেলে বরাতজোরে বড় চাকরি পেলো। সরকারি বা বেসরকারি- সেই প্রশ্ন তোলা থাক। কারণ দুনম্বরি কারবার সবখানেই আছে। একটু কম বা বেশি। চাকরি পেয়ে তার বড্ড পায়াভারি। বিয়েও করে ফেলল জুতসই দেখে। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি, এই মেয়ে একঘাটে পানি খাওয়া মেয়ে নয়। এ বহুত চালিয়াত। ঝড় বুঝে নৌকো পাল্টাতে ওস্তাদ।

তো হল কি, দুনম্বরি করে করে ছেলে মেলা টাকা কামিয়েছে। তা প্রায় কোটি দুয়েক তো হবেই। তার টাকার গরমে পাড়া-প্রতিবেশীর এলাকায় টেকা দায়। জানেন তো, টাকার গরম আর প্রেমের শরম কখনও লুকিয়ে রাখা যায় না। কেউ ঝট করে প্রেমে পড়লেই দেখবেন মুখখানা কেমন বিলিতি বেগুনের মতো লালচে ঠেকে। ছেলের শ্বশুর মওকা বুঝে একখানা জবরদস্ত চাল চাললেন। কণ্ঠে মাখন মেখে বললেন, দেখো বাবা, তোমার তো শুনেছি মেলা টাকাকড়ি। বেনামে সে-নামে রাখবা কি, আমার মেয়ের নামে এক টুকরো জমি কিনে দিলাম। সেখানেই তুমি বাড়িটারি কিছু একটা করো। বাকি জীবন নিজের বাড়িতেই থাকবে, মিছে ভাড়া গুণতে যাবে কেন।

লোভী ছেলের আনন্দ আর দেখে কে! সে তো ‘তিন পায়ে’ খাড়া। শ্বশুরের মেয়েকে এখন সে আগের চেয়ে আরো বেশি করে ভালোবাসতে লাগলো। টাকার বিনিময়ে ভালোবাসাবাসি কর্মসূচি যাকে বলে! অবশ্য চুরিচামারি করতে গেলে তো টাইম দিতে হয়। ফলে বউয়ের ভাগে সময় কম পড়ে। মেয়েরও তাতে তেমন আপত্তি নেই। ছাড়া গরুর মতোন সে সমানে ‘পরক্রীড়া’ চালিয়ে যাচ্ছে। ফাস্টফুড খাচ্ছে, আর দিন দিন বেঢপ হচ্ছে।

শ্বশুরের কিনে দেয়া জমিতে সে শখ করে আটতলা বাড়ি করলো। বিদেশ থেকে মার্বেল পাথর আনলো, যেনো তাজমহল। প্রাসাদের মতো দেখতে হয়েছে বাড়ি। এযাবত কামানো সব টাকা সে ওই বাড়িতে ইনভেস্ট করেছে। তারপর কী হল! ছেলে ভাবলো, টাকা শুধু টাকাই আনে, টাকা যে সুদসমেত জমানো সব টাকা কেড়ে নেয়, সেই ধারণা তার ছিল না। একদিন বাড়ি ফিরে শোনে তার স্ত্রী নেই। সে পালিয়েছে। আগে থেকেই লটঘট চলছিল, সেই প্রেমিকের সঙ্গে সে পালিয়েছে। পালাবে না! এই ছেলে তাকে টাকার লোভ ছাড়া আর কী দিয়েছো। একটু সময় বা ভাব-ভালোবাসা, কিছুই কি সে পেয়েছে।

শুধু স্ত্রী পালালে তাও মানা যেত, কিন্তু সেই সঙ্গে বাড়িখানাও সে বাগিয়ে নিয়েছে। কেননা, এই জমির মালিক তো তার পালিয়ে যাওয়া বউ। সেই জমিতে সে বাড়ি বানিয়েছে অঢেল টাকা দিয়ে, কিন্তু আইন মোতাবেক জমির মালিক যে, বাড়ির মালিকানাও তার। বেচারা অর্থপিশাচ ছেলেটা একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেল!

তাই বলি কি, অত টাকা টাকা করো না। পরিবার আর নিজের শরীরের দিকে নজর দাও। নইলে হাসপাতালের বেডে শুয়ে বাকি জীবন কাতরাতে হবে, সুস্থির হয়ে একটু মরতেও পারবে না।

পাদটীকা: এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ছেলেমেয়েরা বাপের কাছ থেকে টাকাকড়ি বা উপঢৌকন নয় বরং ভালোবাসা পেতে বেশি ভালোবাসে। আমার ঘরে তার প্রমাণও আছে।

লেখক, কথাসাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :