ওয়াসার এমডি: অহংকার, স্মার্টনেস আর বিনয়

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ৩০ এপ্রিল ২০১৯, ১৯:০২

আমরা বসেছিলাম প্রায় পাশাপাশি। ‘প্রায়’ কথাটা বললাম এ কারণে যে, আমাদের দু’জনের মাঝে আরও একজন ছিলেন। এত কাছাকাছি বসে একজনের পক্ষে অপরজনের সমালোচনা করা সহজ নয়। কিন্তু তারপরও আমি করেছিলাম। কারণ আমার মনে হয়েছিলÑ তিনি যে আচরণ করেছেন, যা উচ্চারণ করেছেন, তার সমালোচনা হওয়া দরকার। বলছি ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের কথা। প্রায় দশ বছর ধরে তিনি ঢাকা ওয়াসার শীর্ষ কর্মকর্তা।

ওয়াসার অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব। তবে প্রধানতম দায়িত্ব সম্ভবত নগরবাসীকে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনকে যথাযথভাবে চালু রাখা। এ দুটি কাজ মোটেও সহজ নয়। বরং এতটাই জটিল যে, সামান্য এদিক-ওদিক হলেই তোলপাড় কা- হয়ে যেতে পারে। এমন একটি সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাকে মাঝেমধ্যেই যে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে সেটা কোনো অবাক করা বিষয় নয়। বরং এটাই যেন স্বাভাবিক। সে কারণে গত দশ বছরে একাধিকবার তাকে সমালোচনার মুখে পড়তেও হয়েছে। তবে এবার যতটা হয়েছে, সেটা বোধকরি একটু বেশিই। বেফাঁস কথা বলে একটু বেকায়দাতেই পড়ে গেছেন ভদ্রলোক।

সংকটের শুরুটা হয়েছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’র একটা জরিপভিত্তিক রিপোর্টকে কেন্দ্র করে। গত ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, সেবাগ্রহীতাদের শতকরা ৩৪.৫ ভাগের মতে বছরের সব সময় ওয়াসার পানির গুণগতমান খারাপ থাকে। রিপোর্টে আরো বলা হয়, ঢাকা ওয়াসা পাইপলাইনের মাধ্যমে এখনো সুপেয় পানি সরবরাহ করতে পারেনি। এ কারণে ওয়াসার ৯১ শতাংশ পানিগ্রহীতা খাবার পানি ফুটিয়ে পান করেন। আর ওয়াসার পানি ফোটাতে প্রতিবছর যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করা হয়, তার দাম ৩৩২ কোটি টাকা। অথচ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পাইপলাইনের মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হয়। এছাড়া প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সেবার নিম্নমান এবং সেবা সম্পর্কে প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বেশি সেবাগ্রহীতা অসন্তুষ্ট। প্রতিবেদনে ওয়াসার অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে বলা হয়, সেবাগ্রহীতাদের ৮৬.২ ভাগ ওয়াসার কর্মচারী এবং ১৫.৮ ভাগ দালালকে ঘুষ দিয়ে থাকেন।

এ ঘটনার তিনদিন পর ২০ এপ্রিল পাল্টা এক সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। সেখানে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিম এ খান টিআইবির ওই প্রতিবেদনকে একেবারে বাতিল করে দেন। বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসায় কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি নেই। প্রতিষ্ঠানটি ৯৮ শতাংশ দুর্নীতিমুক্ত। ঢাকা শহরের অধিকাংশ মানুষ ফুটিয়ে নয়, সরাসরি ওয়াসার ট্যাপের পানি পান করেন। আর ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘টিআইবির এটি কোনো গবেষণা নয়, এটি একটি সাদামাটা একপেশে প্রতিবেদন এবং এখানে স্ট্যান্টবাজি করা হয়েছে।’

ওয়াসা এমডির এমন বক্তব্যের পর থেকেই শুরু হয় ব্যাপক আলোড়ন। সমালোচনা আসতে থাকে নানা মহল থেকে। মিডিয়াগুলোতে নানা শ্রেণি ও পেশার লোক তাদের মতামত প্রকাশ করতে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়াতে এমডির বক্তব্যকে ব্যঙ্গ করেও নানা জন বলেন নানান কথা। এমডির সংবাদ সম্মেলনের তিন দিন পর জুরাইন ও পূর্ব রামপুরা থেকে কয়েকজন নাগরিক এক অভিনব প্রতিবাদ করেন। তারা তাদের বাসা থেকে ওয়াসার পানি সঙ্গে নিয়ে হাজির হন কারওয়ান বাজারস্থ ওয়াসা ভবনের সামনে। তারা বলেন, এমডি যখন দাবি করেছেন তাদের পানি শতভাগ সুপেয়, তাই তারা ওয়াসা সরবরাহকৃত পানি নিয়ে এসেছেন, তা দিয়ে এমডি সাহেবকে শরবত বানিয়ে খাওয়াবেন বলে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও তাদের সেই শরবত বানিয়ে খাওয়ানো হয়নি, এমডির দেখাই পাননি তারা। তবে বিষয়টি দারুণ আলোড়ন তুলেছে। রাতারাতি ওয়াসার সুদর্শন এমডি দেশজুড়ে রীতিমতো ভিলেনে পরিণত হয়েছেন। একাধিক টেলিভিশন এ নিয়ে টক শো করেছে। ওয়াসার বিভিন্ন কর্মকর্তাকে সেখানে কথা বলতে দেখা গেছে। বলা বাহুল্য, তাদের কেউই তেমন সুবিধা করতে পারেননি। বরং এলোমেলো কথা বলতে গিয়ে পুরো পরিস্থিতিকেই বলতে গেলে লেজেগোবরে করে ফেলেছেন। ‘ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়’Ñ এমডির এই একটি বাক্যই যেন সকলের অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। ওয়াসার কর্মকর্তারা তো বটেই, কারওয়ান বাজারের সুদৃশ্য ওয়াসা ভবনটিই যেন মানুষের হাস্যরসের উপলক্ষে পরিণত হয়েছে।

এমনই বাস্তবতায় গত ২৬ এপ্রিল এটিএন নিউজ টেলিভিশনে ওয়াসার এমডির সঙ্গে এক টক শোতে বসেছিলাম। আলোচক হিসাবে আমরা দু’জন ছাড়াও ছিলেন ওয়াসার সাবেক চেয়ারম্যান, টিআইবির একজন গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর আগে মি. খান অফএয়ারে কিছু সময় নানা বিষয়ে কথা বললেন। তিনি এর মধ্যে, গত এক দশকে, ওয়াসার উন্নয়নের জন্য কি কি করেছেন, কীভাবে ওয়াসার আধুনিকায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটির আয় বাড়িয়েছেন- সেসব বলার চেষ্টা করলেন। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের একটা প্রকাশনাও দেখালেন, যেখানে ঢাকা ওয়াসার কর্মকা-ের প্রশংসাই করা হয়েছে। ভদ্রলোককে আমরা যথেষ্ট স্মার্ট আর কনফিডেন্ট মনে হলো।

ঠিক এই পর্যায়ে এসে যেন কিছুটা ধারণা করতে পারলাম, প্রেস কনফারেন্সে কেন তিনি এমন দাম্ভিকতাপূর্ণ কথা বলেছেন। আমি আগেও এমন বহুবার দেখেছি, স্মার্টনেস আর অতিআত্মবিশ্বাস মানুষকে অনেক সময় অহংকারী করে তোলে। আর সেই সঙ্গে যদি থাকে ক্ষমতার সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা, তাহলে সেই অহংকারের প্রকাশ ঘটে নানাভাবে, কারণে-অকারণে। জনাব তাকসিম এ খানের ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু ঘটেছে কি না বলা মুশকিল। তবে সত্য মিথ্যা জানি না, এমন কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, সরকারপ্রধানের সঙ্গে তার আত্মীয়তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। তেমন কিছু থেকে থাকলে, সেদিনের প্রেস কনফারেন্সে তার আচরণের একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা অবশ্য পাওয়া যায়।

তবে ব্যাখ্যা যেটিই থাক, মিডিয়ার যে আলাদা একটা ক্ষমতা আছে, তা সে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াই হোক বা সোশ্যাল মিডিয়াই হোক, সেটি বোধকরি ভদ্রলোক এরই মধ্যে টের পেয়ে গেছেন। বিষয়টি আমরাও টের পেলাম। টেলিভিশনের এই আলোচনায় ওনাকে আর কিছুমাত্র উদ্ধত মনে হলো না, বরং অনেকটাই বিনয়ী এবং লজিক্যাল যেন। আর শুরুতেই বলে নিলেন (নাকি গুরুত্বপূর্ণ একটা সংশোধনী দিলেন?), মিডিয়ায় তার বক্তব্য ভুলভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নাকি ‘ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়’Ñ এই কথাগুলোর পর ‘অ্যাট সোর্স’-এই দুটি শব্দ উচ্চারণ করেছেন। সন্দেহ নেই এটা নতুন তথ্য! গত প্রায় এক সপ্তাহে কখনো তার এই সংশোধনীর কথা শোনা যায়নি, কোনো মিডিয়াতে আসেনি। উৎসের কথা যদি তখন বলে থাকেন, তাহলে তার এই বক্তব্য নিয়ে এত বেশি সমালোচনার খুব একটা সুযোগ অবশ্য থাকে না। তবে তিনি আসলেই সেদিন ‘অ্যাট সোর্স’ কথাটি বলেছেন কি না, আমি ঠিক জানি না। তবে যে বিনীত ভঙ্গিতে এমডি সাহেব কথাটি বললেন, তাতে মনে হলো তিনি যেন বলতে চাইছেন, সেদিন না উচ্চারণ করে থাকলেও তিনি আসলে সেই কথাটাই বলতে চেয়েছেন।

আসলেই তো, যে সকল পাম্প থেকে ওয়াসার পানি উত্তোলন করা হয়, সদ্য তোলা সেই পানি আসলেই সুপেয় হয়ে থাকে। ঝামেলা যা কিছু হয়, পানি সরবরাহের সময়। পাম্প থেকে যে পাইপ দিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে পানি পৌঁছে দেয়া হয়, সেই পাইপগুলো নানা কারণে মাঝেমধ্যে ফেটে যায়, তাতে ছিদ্র হয়, আর তাতেই দূষিত হয় পানি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পাইপগুলোর মালিক কে? ওয়াসাই তো? তাহলে ওয়াসা কেন পাইপগুলো মেরামত করে না? এ প্রশ্নেরও জবাব দিলেন এমডি তাসকিম এ খান। বললেন, আমাদেরকে জানালে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিই। তিনি তাদের হটলাইনের কথা বললেন, ১৬১৬২- এই নম্বরে ফোন করে অভিযোগটা কেবল জানালেই হয়। অভিযোগ জানানোর পর কাজ হয়নি এমন কোনো উদাহরণ নাকি নেই তার কাছে!

এর মাঝে একটা পত্রিকায় পড়লাম, এই এমডি সাহেব নাকি ওই মিজানুর রহমান সাহেব, যিনি তাকে শরবত খাওয়াতে চেয়েছিলেন তাকে ‘পাগল’ বলে অভিহিত করেছেন। কাউকে পাগল বলা নিশ্চয়ই শোভন নয়। তবে মিজান সাহেবের কাজকর্ম যে পুরো ওয়াসাকেই কিছুটা বিব্রত করতে পেরেছেÑ এটা মানতে হবে। আমাদের ওই টক শোতে মিজান সাহেবকেও সংযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি তখন একটা বালতিতে ওয়াসার ময়লাযুক্ত পানির নমুনা দেখালেন। এমডি সাহেব সঙ্গে সঙ্গে সেই বাড়ির হোল্ডিং নম্বর জানতে চাইলেন। সেটি আর বললেন না মিজান সাহেব। সেই অনুষ্ঠানেই আর একজন দর্শক ফোন করে জানালেন- তার এলাকার মিটার রিডার প্রতিটা বাড়ি থেকে উৎকোচ নেয়। কিন্তু যখন সেই মিটার রিডারের নাম জানতে চাওয়া হলো, তিনি তা বললেন না। পীড়াপীড়ি করার পরও বললেন না। এখন প্রশ্ন হলো অভিযোগ সুনির্দিষ্ট না হলে দ্রুত প্রতিকারই বা হবে কীভাবে? তাহলে কি অভিযোগ মাঝে মাঝে ঢালাও হয়ে যায়? এক পর্যায়ে এমডি সাহেব সরাসরি আমাকেই জিজ্ঞাসা করলেন- আপনার বাসার পানি কেমন? বললাম- আমার বাসার পানি তো ভালোই। সেখানে অন্য যারা ছিলেন তারাও কেউ তাদের বাসার পানিকে খারাপ বললেন না! তাহলে দাঁড়ালোটা কি? তাকসিম সাহেব বললেন- কোনো একজন গ্রাহক তার সমস্যার কথা জানানোর পরও প্রতিকার পাননি এমন একটি উদাহরণ আপনারা নিয়ে আসুন। যেন অনেকটা ওপেন চ্যালেঞ্জ। পরে আবার বললেন, আপনারা তো অনেকদিন ধরেই ঢাকাতে আছেন। পানি নিয়ে এই শহরে গুলির ঘটনা পর্যন্ত হয়েছে। তারপর মানুষ তো আরও বেড়েছে, সংকট আরও তীব্র হওয়ার কথা। হয়েছে কি? ওয়াসার সেবার মান কি আগের চেয়ে ভালো হয়নি? আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ পর্যায়ে, উপস্থাপক মুন্নী সাহা সরাসরি আমার কাছেই জানতে চাইলেনÑ এত দীর্ঘ আলোচনার পর এমডি সাহেবের প্রতি আমার মনোভাবের কথা। বললামÑ আমার কাছে ওনাকে খুবই স্মার্ট এবং একই সঙ্গে দুর্ভাগা বলে মনে হয়েছে। এতক্ষণ কথা বলে মনে হলো ওনারা অনেক কিছু করছেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো যখন মিজান সাহেবরা শরবত নিয়ে ওনার অফিসের সামনে যান তখন ঢাকার মানুষ কিন্তু মিজান সাহেবকেই বিশ্বাস করেন, তাকসিম সাহেবকে নয়। আর এই যে অবিশ্বাস, সেটা ব্যক্তি তাকসিম সাহেবের জন্য নয়, বরং প্রতিষ্ঠান ওয়াসার জন্যই। দীর্ঘ এত বছর ধরে ওয়াসা মানুষের মধ্যে যে অবিশ্বাস ও বিরক্তি তৈরি করেছে, সেটার দায় ওনাকেও বহন করতে হচ্ছে। দশ বছরে সেই বিরক্তি মানুষের মন থেকে উনি মুছে ফেলতে পারেননি। ওয়াসার প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের মনে এই প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে আস্থাটিও ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সে কাজটি ওনাকেই করতে হবে।

কিন্তু কীভাবে ফিরবে সেই আস্থা? ঔদ্ধত্য আর অহংকার দিয়ে নয়। বরং ওই টক শোতে যে বিনয় ও ভুল স্বীকারের মানসিকতা ওয়াসাপ্রধান দেখিয়েছেন, সেটিই তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অন্য কিছু নয়।

মাসুদ কামাল: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :