সুপার শপে সুপার বাজার

সৈয়দ ঋয়াদ ও নজরুল ইসলাম
 | প্রকাশিত : ০২ মে ২০১৯, ১১:২৪

সাপ্তাহিক হাটের চলন নেই বললেই চলে। বাজারে ভিড়ও কমছে স্পষ্ট। কিন্তু নিত্যপণ্যের চাহিদা বেড়েই চলেছে। গোলমেলে লাগছে? হাট-বাজার নেই, কিন্তু পণ্য বিক্রি বেশিÑ এটা কেমন কথা? হ্যাঁ, এই বিষয়টি সম্ভব করেছে হরেক রকম পণ্য বিক্রির বড় প্রতিষ্ঠান, যেগুলো সুপার শপ নামে পরিচিতি পেয়েছে।

একই ছাদের নিচে কাঁচাবাজার, মুদি পণ্য, প্রসাধন, মুখরোচক খাবার, মাছ-মাংস, কাঁচা ও শুকনো ফল, শিশুদের খাবার ও প্রসাধনী, নারীদের নানা পরিচ্ছন্নতার উপকরণ, এমনকি হাঁড়িপাতিল, ঘর সজ্জার সবই পাওয়া যায়।

এ তো গেল পণ্যের সমাহারের বিষয়টি। সেখানকার পরিবেশও গোছানো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ, বিক্রেতাদের ভদ্র আচরণের কারণে চাহিদা বাড়ছে নিত্যদিন। বড় শহর ছাড়িয়ে মফস্বলেও বাজার করার ধারণাকে আমূল পাল্টে দিচ্ছে ‘সুপার শপ’।

সুপার শপ কী এবং কেন?

উন্নত বিশ্বে বহু আগে থেকে সুপার শপ চালু থাকলেও আমাদের দেশে এই ধারণাটা নতুনই বলা চলে। গত দশকের গোড়ার দিকে মূলত আমাদের দেশে সুপার শপের যাত্রা শুরু।

এখানে বিক্রেতারা পরিপাটি পোশাকে থাকে, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া তরুণ-তরুণীও। এদের সম্বোধনে থাকে সম্মান।

২০০১ সালে ধানমন্ডিতে আগোরার একটি স্টোরের মধ্য দিয়ে পথচলা শুরু করে দেশের রিটেইল চেইন ইন্ডাস্ট্রি। উচ্চবিত্তদের কেনাকাটার স্থান হিসেবে শুরু হলেও এখন মেগাসিটির বহু মধ্যবিত্ত পরিবারের গন্তব্য আগোরা, মীনা বাজার, স্বপ্নর মতো সুপার স্টোর। ১৮ বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেড় শতাধিক ছোট-বড় স্টোরের বার্ষিক বিক্রি এখন দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

স্বপ্ন সুপার শপ মালিবাগ শাখার ইনচার্জ মিল্টন মন্ডল এই সময়কে বলেন, ‘মানুষের হাতে সময় নেই। তার উপর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এক সঙ্গে পেতে ঝক্কি পোহাতে হয়। সে কারণেই ক্রেতারা এখন কেনাকাটার জন্য বাজারের চেয়ে সুপার শপেই বেশি আসছে।’

বাজারের চেয়ে সুপার শপের পণ্যের মূল্য কম না বেশি জানতে চাইলে স্বপ্নের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের পণ্যের মূল্য বাজারের মতোই। তবে বহু ক্ষেত্রে এটা বাজার দরের চেয়ে কম। সেই সঙ্গে মানের নিশ্চয়তা আছে।’

স্বপ্নর মালিবাগ আউটলেটে বাজার করতে আসা এক দম্পতির সঙ্গে দেখা। এদেরই একজন রেহনুমা পারভীন। পেশায় ব্যাংকার। বলেন, ‘আমরা দুজনই চাকরি করি। রাতে যখন ফিরি তখন সাধারণত বাজারে খুব একটা ভালো কিছু পাওয়া যায় না। এখানে সেই ঝামেলা নেই। সময় বেঁচে যায়। সে কারণইে আসি।’

পাশ থেকে তার স্বামী মনসুর আহমেদ বলেন, ‘এখানে বাজার করতে ৩০ মিনিট লাগলে বাজারে সেটা করতে দুই ঘণ্টা। তার উপর ব্যাগ টানাটানি করতে করতেই সময় শেষ। তার উপর এটা পাইতো ওটা নাই। সুপার শপে অন্তত এই ঝামেলা নেই।’

আরেক ক্রেতা স্কুল শিক্ষক রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে বাজার করার সুবিধা অনেক, অসুবিধাও আছে। ভ্যাটের পরিমাণ একটু কম হলে ভালো হতো। আমরা নি¤œ মধ্যবিত্ত। সময়ের অভাবেই সুপার শপে আসি। কারণ সকাল থেকেই স্কুল। বাজারে গিয়ে তিন ঘণ্টা ধরে বাজার করার সময় কোথায়। তবে সুপার শপ থাকায় আমাদের মেয়েদের জন্য সুবিধা হয়েছে বাজারে ঘোরার ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না।’

কী নেই সুপার শপে?

জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কী নেই সুপার শপেÑ সেটাই এক বড় প্রশ্ন হতে পারে। চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, মাছ (জ্যান্ত মাছও পাওয়া যায়), মাংস, মশলা, ফলমূল থেকে শুরু করে পোশাক, প্রসাধন, জুয়েলারি, ক্রোকারিজ, ইলেকট্রনিক্স, স্টেশনারি, শিশুদের খেলনা, বইও পাওয়া যাচ্ছে।

রাইস কুকার, ব্লেন্ডার মেশিন, গ্যাসের চুলা, পাতিল, কড়াই, বোল, বাটি, ট্রে, বালতি, মগ, জগ, প্লেট, চামচ। বিভিন্ন ধরনের সবজি কাটার ছুরি, কিচেন চপিং বোর্ডসহ রয়েছে নানা প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।

নগরের বড় সুপারশপগুলোতে মিলছে বৈদ্যুতিক বাতি, রুম হিটার, টেলিভিশন, ওয়াশিং মেশিন, ইস্ত্রি।

পোশাক ও প্রসাধনের বিশাল আয়োজনও রেখেছে কেউ কেউ। প্রসাধনের কর্নারে রয়েছে বিদেশি নানা ব্র্যান্ডের পণ্য। আছে লোশন, ক্রিম, পাউডার, মেকআপ বক্স, মাশকারা, কাজল, ফাউন্ডেশন, আইলানার, আইস্যাডো, লিপস্টিকসহ নানা রকম সুগন্ধি পণ্য।

ধানমন্ডির কেমার্ট সুপার শপের ব্যবস্থাপক রাকিব আহমেদ বলেন, ‘শহরের মানুষ এমনিতে ব্যস্ত। তাদের জন্য বাজারের সময় কমাতে কমাতে এক ছাদের নিচে সব আয়োজন রাখছি।’

মাছ-মাংসে অনীহা

চাল, সয়াবিন তেল, সবজি, শাক আর প্রয়োজনীয় বেশ কিছু সদাইপাতি নিয়ে আগোরা সুপার শপে ট্রলি নিয়ে কাউন্টারের দিকে আগাচ্ছিলেন পূর্ব রাজাবাজারের গৃহিণী মোমেনা তাবাসসুম। বলেন, ‘আমি বাসার জন্য বেশিরভাগ বাজারই করি সুপার শপে। তবে মাছÑমাংসের বিষয়ে অনীহা রয়েছে। কারণ এখানে থাকা মাছ-মাংস খেতে সুস্বাদু নয়। তাছাড়া এই জিনিসগুলো তাজা না খেলে ভালো লাগে না।’

আরেক গৃহিণী সীমা আক্তারেরও একই ভাষ্য। তিনি সুপার শপে সব কেনাকাটা করলেও মাছ-মাংসের বেলায় স্থানীয় বাজারকেই বেছে নেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আগোরার গ্রিন রোড শাখার প্রধান শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখানে ক্রেতারা সব পণ্যই স্বাচ্ছন্দ্যে কেনেন। তবে মাঝে মাঝে মাছ-মাংসে ক্রেতাদের কিছু অভিযোগ দেখা যায়। আমরা চেষ্টা করি শতভাগ ভালো জিনিস দিতে। যদি কোনো ক্রেতা অভিযোগ করেন মাছ বা মাংস পচা বা নরম। সেক্ষেত্রে আমরা পরিবর্তন করে দেই।’

একই ভাষ্য ওয়ান স্টপের অফিসার ইনচার্জ মাহবুব আলমের। তিনিও জানান, মাছ বা মাংসের মূল রঙে পরিবর্তন এলে সেটা নষ্ট করে দেওয়া হয়। কারণ খারাপ জিনিস দিয়ে ক্রেতা হারাতে নারাজ তারা।

ঢাকায় জনপ্রিয় কিছু সুপার শপ

আগোরা

রহিম আফরোজ সুপার স্টোরস লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত ‘আগোরা’ বাংলাদেশের প্রথম সুপার শপ স্টোর। ২০০১ সালে প্রথম আউটলেটের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু। প্রচলিত বাজার ব্যবস্থার বাইরে ‘সুপার শপ’-এ কেনাকাটা কতটা জনপ্রিয় হতে পারে সে প্রমাণ রেখেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা শহর ছাড়াও বিভাগীয় শহর চট্টগ্রামে রয়েছে তাদের শাখা।

মগবাজার আগোরার এক কর্মী বলেন, ‘এখানে প্রচুর ক্রেতার ভিড় থাকে সপ্তাহের প্রতিদিনই।’

কথা হয় আফজাল হোসেন নামে এক ক্রেতার সঙ্গে। বলেন, ‘বাজারে গেলে শরীরে অস্বস্তি লাগে। এখন বেশিরভাগ বাজারের পরিবেশ খুব নোংরা। সুপার শপে কিন্তু এই সমস্যা নেই। রোদেও পুড়তে হয় না।’

‘অনেকের ধারণা সুপার শপে বাজার করলে বেশি খরচ হয়, এই ধারণাটি একেবারেই ভুল। বরং কিছু পণ্য বাজারের চেয়ে কম দামে পাওয়া যায় সুপার শপে। আর কার্ড পেমেন্টের ক্ষেত্রে প্রচুর অফার থাকে।’

মীনা বাজার

দেশের যে কয়টি চেইন সুপার শপ খুব বেশি জনপ্রিয় তার মধ্যে অন্যতম ‘মীনা বাজার’। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তাদের রয়েছে ১৮টি শপ। প্রতিষ্ঠানটির ইস্কাটন শাখা ইনচার্জ আবদুস সালাম এই সময়কে বলেন, ‘আমাদের কোনো প্রোডাক্টই থার্ড পার্টির নয়। আমরা সরাসরি উদ্যোক্তা বা উৎপাদক থেকে পণ্য নিয়ে থাকি। অনেক সময় অভিযোগ থাকে একই পণ্য আমাদের চেয়ে অন্যরা কম দামে বিক্রি করে কীভাবে। কারণ আমরা পণ্যের ব্যাপারে কোনো ধরনের আপস করি না।’

স্বপ্ন

শুরুর দিকে না হলেও এখন দেশে প্রধান সুপার শপগুলোর একটি এসিআই গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানটি। এখন দেশে সবচেয়ে বেশি আউটলেট এই প্রতিষ্ঠানটির।

২০০৮ সালে রিটেইল চেইন নিয়ে মাঠে নামে এসিআই গ্রুপ। সাবসিডিয়ারি এসিআই লজিস্টিকসের অধীনে ব্যবসা পরিচালনা করছে তাদের রিটেইল চেইন ‘স্বপ্ন’।

মাত্র এক দশকের পথচলায় স্বপ্নর রিটেইল আউটলেট সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়েছে। প্রতিদিন অন্তত ৩৫ হাজার পরিবারে স্বপ্নর পণ্য পৌঁছায়। নিবন্ধিত ক্রেতার সংখ্যা ছয় লাখ ছাড়িয়েছিল গত বছরই।

মালিবাগ স্বপ্ন আউটলেটে বাজার করতে আসা শামসুদ্দিন নামে এক কলেজ শিক্ষক বিষয়টি আরও সহজ করে বললেন। তার ভাষ্য, ‘শুরুতে ভয়ে ঢুকতাম না, ভাবতাম অনেক দাম। একদিন সাহস করে ঢুকে দেখি বাজারের চেয়ে কম দামে সবজি বিক্রি হচ্ছে। আবার রকেট বা বিকাশে পেমেন্ট করলে পাওয়া যাচ্ছে ছাড়। সব কিছু মিলিয়ে অনেকটা অবাক হয়েছি। এর পর থেকে বাইরে বাজার করা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছি।’

ডেইলি শপিং

এটি প্রাণ গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি দ্রুত বর্ধনশীল। এদের রয়েছে ৫৯টি আউটলেট। ডেইল শপিং-এর কাঁঠাল বাগান ফ্রি স্কুল স্ট্রিট শাখার একজন কর্মী বলেন, ‘আমাদের আউটলেটের সংখ্যা এখনো তুলনামূলক কম। তবে দিন দিন আরও বাড়ছে।’

এই প্রতিষ্ঠানটি ক্রেতাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে না, এই অর্থ তারাই পরিশোধ করে গ্রাহকদের হয়ে।

প্রাণের নিজস্ব পণ্যে এখানে বেশ বড় অঙ্কের ছাড় পাওয়া যায় বছরজুড়ে। নতুন অফার থাকলে গ্রাহকদের ফোন নম্বরে এসএমএসের মাধ্যমে তা জানিয়ে দেওয়া হয়। বিকাশ, রকেট-এর মতো পেমেন্ট সার্ভিসগুলো কেনাকাটায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে এখানে।

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ডেইলি শপিং শাখায় বাজার করতে আসা ইয়াসমিন হক নামের এক ক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। বলেন, ‘আমি একা মানুষ, ছেলেমেয়েরা সবাই বাইরে থাকে। অসুস্থতার কারণে বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করার মতো সাহস পাই না। আর এখানে যারা কাজ করে তারাই সব প্যাকেট করে গাড়িতে তুলে দেয়। বাজারদরের চেয়ে দাম কিন্তু বেশি নয়।’

নন্দন মেগা শপ

কেনাকাটা বা বাজারসদাই তাদের ভাষায় ‘বিনোদন’। আর এমন ধারণা নিয়ে দেশীয় রিটেইল চেইন শপ ‘নন্দন’-এর যাত্রা শুরু। ঢাকার ধানমন্ডি, গুলশান, কাকরাইল, মিরপুর উত্তরাসহ শহরে রয়েছে তাদের আরও বেশ কিছু আউটলেট।

সব সুপার শপের মতো তাদের রয়েছে মেম্বারশিপ কার্ড। কার্ডধারী সদস্যরা মাসে তিন হাজার টাকার কেনাকাটায় পেয়ে থাকেন ৩ শতাংশ কমিশন আর ৫ হাজার টাকার উপরে কেনাকাটায় পাঁচ শতাংশ কমিশন। আর কমিশনের টাকা পেয়ে থাকেন নন্দন থেকে পণ্য কেনার সুবিধা। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টধারীদের জন্য থাকে নানা রকম ডিসকাউন্ট অফার।

প্রিন্স বাজার

সুপার শপে প্রিন্স বাজারের পথচলাও বেশ পুরোনো। ‘প্রিন্স বাজার’ নামে জনপ্রিয় এই সুপার শপ তাদের যাত্রা শুরু করে ২০০৫ সালে। খুব বেশি আউটলেট না থাকলেও মানের দিক থেকে প্রিন্স বাজার ক্রেতাদের কাছে বিশ্বস্ত একটি নাম। শাক-সবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস, জামাকাপড় থেকে বিখ্যাত ব্র্যান্ডের লিপস্টিকসহ প্রয়োজনের হাজারো সরঞ্জাম রয়েছে একই ভবনে। মিরপুর আউটলেটের মাধ্যমে প্রিন্স বাজারের যাত্রা।

মিরপুর ছাড়াও মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটির বিপরীত পাশে এই সুপার শপের একটি চেইন শপ রয়েছে। সপ্তাহের সাত দিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই শপের প্রতিটি শাখা খোলা থাকে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

অর্থনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

অর্থনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :