এলজিইডি প্রধানের বিএনপি কানেকশন...

প্রকাশ | ০৫ মে ২০১৯, ১০:৪৬ | আপডেট: ০৫ মে ২০১৯, ১০:৫৬

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস

গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এলজিইডির অনুষ্ঠানে যা ঘটেছে, তা এখনো অবিশ্বাস্য ঠেকছে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাছে। ওই অনুষ্ঠানে বক্তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান পুরুষ জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্বোধন করায় ধমকিয়েছেন এলজিইডি প্রধান আবুল কালাম আজাদ। বলেছেন, ‘এটা সরকারি অনুষ্ঠান। দলীয়করণ কেন করছেন?’ তিনি নিজেও বক্তৃতায় শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু বলেননি। 

এলজিইডির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর মধ্যে চাউর আছে, আবুল কালাম আজাদ বিএনপিপন্থী প্রকৌশলী। বিএনপিপন্থী প্রকৌশলীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (এইবি) সদস্য ছিলেন। 

তাই আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এলজিইডির সর্বোচ্চ পদে তার নিয়োগে বিস্মিত হয়েছিলেন সংস্থাটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। 

এলজিইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও তিনি বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। যে কারণে নির্বাচনের সময় বড় বড় প্রকল্পের টাকা ছাড় করেননি। ভেবেছিলেন, সরকার পরিবর্তন হলে বর্তমান সরকারের সময় নেওয়া বড় প্রকল্পগুলো মাঝপথে শেষ করে দেবেন। বিষয়টি নিয়ে তার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে গল্পের ছলে আলাপও করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে শোনা যায়।

আগামী ৮ মে প্রধান প্রকৌশলীর অবসরে যাওয়ার কথা। তবে তিনি তার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করছেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও তার ঘনিষ্ঠদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। তবে তাকে নিয়ে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে অস্বস্তি রয়েছে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এলজিইডির বিভিন্ন কার্যক্রমের গতি কমেছে। অস্বস্তি ও অসন্তোষ ছড়িয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের তৃণমূলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও। 

আবুল কালাম আজাদের বাড়ি পাবনায়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, যদি বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসে, তাই নির্বাচনের আগে থেকে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গেও গোপনে যোগাযোগ ছিল তার। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামছুর রহমান শিমুল বিশ^াসের সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক রয়েছে। নির্বাচনের সময় বিশেষ দূত পাঠিয়ে বিএনপি নেতাদের আর্থিক সহযোগিতার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ-সম্পর্ক অটুট রেখেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠমহলে আলোচনা আছে। 

এদিকে তার শেষ সময়ে এসে এলজিইডিতে ঢালাও পদোন্নতি ও পদায়ন চলছে। গত ২১ এপ্রিল একসঙ্গে ২৮ জন সহকারী প্রকৌশলীকে জ্যেষ্ঠতা দিয়ে তাদের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে (চলতি দায়িত্বে) বিভিন্ন জেলায় পদায়ন করা হয়েছে। এই বিষয়টি নজিরবিহীন। এলজিইডির সদর দপ্তরের যে কোনো রদবদলের প্রজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়া হলেও এসব পদায়নের কোনো প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়নি।

এ সবই এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদের একক সিদ্ধান্তে হচ্ছে বলে দপ্তরের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। ঢালাও এই পদোন্নতিতে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে খোদ এলজিইডিতেই। এ নিয়ে সংস্থাটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়েছে। চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে বঞ্চিতদের মধ্যে।

তবে যারা এই অভিযোগ করছেন, তাদের কেউ বিড়ম্বনায় পড়বেন ভেবে প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাইছেন না। আবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এসব বিষয়ে চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করছেন। আর প্রধান প্রকৌশলীর নম্বর বেজে চললেও তিনি তা ধরছেন না। 

এলজিইডির কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, আবুল কালাম আজাদ শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে এসব পদোন্নতি ও পদায়ন দিচ্ছেন। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে তিনি আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। এর মধ্যে তার ঘনিষ্ঠদের সংখ্যাই বেশি। যারা বিভিন্ন সময় তার অনিয়ম-দুর্নীতিতে সহায়তা করেছেন। 

সম্প্রতি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করেছেন। তাদের অভিযোগ, আবুল কালাম আজাদ প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার পর থেকে তাদের চাকরির অনিশ্চয়তা শুরু হয়। এক যুগের বেশি অস্থায়ী পদে কর্মরতদের স্থায়ী করার বদলে বিনা নোটিশে ইচ্ছেমতো তাদের ছাঁটাই করা হয়েছে। এসব নিয়ে তৃণমূলে আছে ব্যাপক অসন্তোষ। 

এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে তিনি এসএমএসে বলেন, তাকে আরেক এসএমএসে বিস্তারিত জানাতে। তবে বিষয়টি নিয়ে এসএমএস করা হলে তিনি আর জবাব দেননি।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ঢালাও পদোন্নতির বিষয়টি আমি অবগত নই। আমি দেশের বাইরে আছি। ফিরে এসে খোঁজ নেব। কোনো অনিয়ম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

এলজিইডি প্রধানের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ:

এলজিইডিতে মাস্টাররোলে অফিস সহায়ক ছিলেন নুরুল ইসলাম নুরু। প্রথম দুই বছর বিনা বেতনে এবং পরে ১৯ বছর তিনি দৈনিক ভিত্তিতে বেতনভুক্ত কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে চলা আন্দোলনে নেতৃত্ব ও ১ মে উপলক্ষে পোস্টার লাগানোয় সহায়তা করায় ২৮ জানুয়ারি তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর আগে অফিস সহায়ক থেকে তাকে মালির কাজে নিযুক্ত করা হয়। পরে মালির কাজ ঠিকমতো করছেন না কারণ দেখিয়ে বরখাস্ত করা হয়। 

বর্তমানে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন নুরু। তিনি এলজিইডির কর্মচারী ঐক্য পরিষদের খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

নুরুর মতো চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলন করার কারণে বিপাকে পড়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) শত শত কর্মী। আন্দোলনকারীদের (মাস্টাররোল ও প্রকল্প) কালোতালিকাভুক্ত করে অনেককে নতুন করে কোনো প্রকল্পে কাজের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। আবার যারা বিভিন্ন প্রকল্পে বর্তমানে কর্মরত, তাদের ঠিকমতো বেতন দেওয়া হচ্ছে না।

একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রধান প্রকৌশলী টাকার বিনিময়ে এলজিইডিতে বিভিন্ন পদে চাকরিতে নিচ্ছেন। আগে প্রকল্প ও মাস্টাররোলের তিন হাজার ৮২৩ জন থাকলেও তাদের স্থায়ী না করে নতুনদের নেওয়া হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। এর মধ্যে ব্রিজ প্রকল্প, যশোর প্রকল্প, রংপুর বিভাগীয় আরসিআইডি প্রকল্পে অসংখ্য লোক নেওয়া হয়েছে, যারা একদম নতুন। কিন্তু এলজিইডির আগের প্রকল্পগুলো শেষ হওয়ার পর যারা বেকার ঘুরছে তাদের কাজ দেওয়া হচ্ছে না। 

২০১০ ও ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট এলজিইডির মাস্টাররোল ও উন্নয়ন প্রকল্পের সাত হাজার ৫২৬ জনের স্থায়ী নিয়োগ দিতে রায় দেয়। রায়ের পর তিন হাজার ৮২৩ জনকে স্থায়ী করা হয়। পদ শূন্য না থাকায় বাকিদের পরে স্থায়ী করা হবে বলে তখন ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি পাঁচ হাজারের বেশি পদ শূন্য থাকলেও মাস্টাররোল ও উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। এলজিইডির মাস্টাররোলে দুই হাজার ১৫০ এবং প্রকল্পে এক হাজার আট শর বেশি কর্মী রয়েছে।

চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে গত ২৬ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর আগারগাঁও এলজিইডি ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করে কর্মীরা। পরে এলজিইডি প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আশ^াসে তারা আন্দোলন স্থগিত করে। কিন্তু পরে কোনো আশ^াসই বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি এলজিইডির পক্ষ থেকে দুই পদে (সার্ভেয়ার ও ইলেকট্রিশিয়ান) লোক নিতে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা আদালতে রিট করেন। এর মধ্যেও দুই পদে লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে।

এলজিইডির পিএসএসডব্লিউ প্রকল্পে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ করেছেন আজাদ শিকদার। চাকরি স্থায়ীকরণের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তাকে আর নতুন কোনো প্রকল্পে কাজের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বর্তমানে পরিবার নিয়ে বিপাকে তিনিও। বেশ কয়েকবার প্রধান প্রকৌশলীর শরণাপন্ন হলেও নতুন কোনো প্রকল্পে কাজের সুযোগ দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া।’

আজাদ শিকদার বলেন, ‘যুগের পর যুগ দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে এলজিইডিতে কাজ করে গেলেও এখন স্থায়ী করা হচ্ছে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও এলজিইডি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তার কারণে এটি কার্যকর হচ্ছে না। এখন আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ কী? চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলন করার কারণে এখন কোনো প্রকল্পে কাজের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি বেশ কয়েকজনকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আমার পরে যারা চাকরিতে প্রবেশ করেছিল তাদের ৩০ জনের বেশি কর্মীকে বিভিন্ন প্রকল্পে চাকরি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাকে দেওয়া হচ্ছে না। এখন আমরা কার কাছে যাব চাকরি চাইতে?’

‘স্থায়ী নিয়োগ না হওয়ায় প্রায় সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী দুশ্চিন্তায় স্ট্রোকে মারা গেছেন। এবারের আন্দোলনে প্রায় বিশজনের বেশি কর্মী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন’ বলেন আজাদ শিকদার।