গতি ফিরছে পুঁজিবাজারে

রহমান আজিজ
 | প্রকাশিত : ০৬ মে ২০১৯, ০৮:১৭

টানা পতনের বৃত্ত থেকে বের হয়ে পুঁজিবাজারে এখন স্বস্তির আভাস। বাজারে আস্থা ও তারল্য সংকট দূর করতে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেশ কিছু উদ্যোগের পর টানা দুই কার্যদিবসে বড় ধরনের উত্থান হয়েছে। বেশিরভাগ শেয়ারের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে বাজার মূলধন।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের আশা, আস্থাহীনতার বৃত্ত কেটে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে পুঁজিবাজারে। বিনিয়োগকারীরাও তাদের পুঁজি ফিরে পাওয়ার আশায়।

গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠনের পর এক মাসেরও বেশি সময় টানা বেড়েছে পুঁজিবাজার। তবে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় দর সংশোধন। আর এই সংশোধন প্রলম্বিত হতে থাকলে এক পর্যায়ে প্রায় ৮০০ পয়েন্ট হারায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও একই দশা। আতঙ্ক ছড়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি, সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ-আইসিবি তৎপর হয়। বৈঠকের পর বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংসদে দেন নির্ভয় বাণী। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে এক দিনেই সূচক বাড়ে ৮৩ পয়েন্ট। গতকাল সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে বড় উত্থানে সূচক বেড়েছে আরও, মোট ১০৮ পয়েন্ট। আর এতেই কালোমেঘ কাটার আশায় বুক বেঁধেছেন বিনিয়োগকারীরা।

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী আসাদুজ্জামান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরে শেয়ারবাজারে দরপতনে আমি প্রায় অর্ধেক পুঁজি হারিয়ে ফেলেছি। গত তিন দিন ধরে বাজার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে। আমি এখন খুবই আশাবাদী বাজার স্থিতিশীল হবে।’

পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করতে সরকারি উদ্যোগের দাবিতে গত এপ্রিলে অনশন থেকে শুরু করে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাও। চূড়ান্ত হতাশায় পড়া বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদও এখন আশাবাদী হয়ে উঠছে। পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘সরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে। এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করলে হবে না। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে তারল্য সংকট থেকে যাবে। আর আমাদের দাবি, ইস্যুমূল্যের চেয়ে দর নেমে গেলে কোম্পানির মালিক পক্ষ যেন বাজার থেকে শেয়ার কিনে নেয়। এ জন্য বাই ব্যাক আইনের প্রয়োজন।’

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর আশ্বাসে গতি ফিরে পুঁজিবাজার। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এতে করে বাজার আরও গতিশীল হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

গত ২৪ জানুয়ারির পরে ৬১ কার্যদিবসে প্রায় ৭৭৫ পয়েন্ট কমেছিল ডিএসইএক্স প্রধান সূচক সূচক। ওই দিন ডিএসইএক্স ছিল পাঁচ হাজার ৯৫০ পয়েন্ট। সর্বশেষ গত ২৯ এপ্রিল সূচক প্রায় ৮০০ পয়েন্ট কমে হয় পাঁচ হাজার ১৭৫ পয়েন্টে অবস্থান করছিল।

গত সোমবার বাজার সংশ্লিষ্ট সবপক্ষের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এতে সিদ্ধান্ত হয় শেয়ারবাজারে বহু বিতর্কিত প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আগে ইস্যু করা প্লেসমেন্ট শেয়ার আইন বাতিল করা হবে।

এর ফলে এখন নতুন করে প্লেসমেন্টে শেয়ার ইস্যু করা বন্ধ হবে। এ ছাড়া আইপিওর আগে ইস্যু করা সব ধরনের শেয়ারে তিন বছর লক-ইন (বিক্রয় অযোগ্য) থাকবে যা আবার লেনদেন শুরুর দিন থেকে গণনা করা হবে। এ ছাড়া এখন থেকে কোনো কোম্পানি নির্ধারিত মূল্য পদ্ধতির আইপিওর মাধ্যমে বাজারে শেয়ার ছাড়তে চাইলে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা ও বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করতে হবে। এর কম হলে ওই কোম্পানিকে শেয়ার ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হবে না।

আবার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আইপিওতে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের (এলিজেবল ইনভেস্টর) কোটা কমানো হবে। এক্ষেত্রে নির্ধারিত মূল্য পদ্ধতিতে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের কোটা ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করা হবে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে সক্রিয় নয় এমন ডিলার, প্রভিডেন্ট ফান্ড, মার্চেন্ট ব্যাংকস যোগ্য বিনিয়োগকারীর তালিকা থেকে বাদ যাবে।

এর মধ্যে আবার তারল্য সংকট কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আইসিবিকে ৮৫৬ কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগও ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ারই বিনিয়োগের উপযোগী। বাজারে প্রাইস আর্নি রেশিও বা পিই লোভনীয় পর্যায়ে। অর্থনীতির জন্যও খারাপ কোনো খবর নেই।

আবার আগামী অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা থাকার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কোম্পানির লভ্যাংশের ক্ষেত্রে বর্তমানে দ্বৈত কর রয়েছে, এবারের বাজেটে তা প্রত্যাহারের ঘোষণা থাকতে পারে। স্ট্যাম্প ডিউটি কমানোসহ আরও কিছু প্রণোদনা থাকবে।

বিএসইসি জানিয়েছে, উদ্যোক্তাদের নিজ কোম্পানিতে ৩০ শতাংশ এবং পরিচালকদের আলাদাভাবে দুই শতাংশ শেয়ার বাধ্যতামূলক করতে কিছু করা যায় কি না তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।

শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমার গণনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক আছে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে যে বিনিয়োগ করে সেটা ক্রয়মূল্য অথবা বাজার মূল্যের মধ্যে যেটা বেশি সেটা ধরে হিসাব করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বিনিয়োগকারীদের দাবি আছে, ক্রয়মূল্যে এটা হিসাব করা। বিষয়টি নিয়ে গণভবনে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর এই সমস্যার সমাধান করবেন বলে কথা দিয়েছেন।

জানতে চাইলে রশিদ ইনভেস্টমেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের এমডি ও ডিএসইর সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী আশ্বাসে পুঁজিবাজার গতি ফিরতে শুরু করেছে। আশা করি, বাজার আরও গতিশীল হবে।’

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় প্রণোদনা স্কিমের ৮৬৫ কোটি টাকা আইসিবির মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা হয়তো মনে করছেন তাদের সুবিধা হবে। এজন্য তারা বিনিয়োগ করছেন। এ কারণে বাজারে সূচক বাড়ছে।’

‘তবে মাঝেমধ্যে প্রণোদনা দিয়ে বাজার বেশিক্ষণ স্থিতিশীল রাখা সম্ভব না। এর জন্য দরকার ভালো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা। একই সঙ্গে বাজারে সুপারভিশন নিশ্চিত করা’-আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ কী সেটাও বলেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান।

গতকালের বাজারচিত্র

রবিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ডিএসইএক্স বা প্রধান মূল্যসূচক ১০৮ দশমিক ১৫ পয়েন্ট বেড়ে পাঁচ হাজার ৩৯৪ দশমিক ৯০ পয়েন্টে অবস্থান করছে। ডিএসইএস বা শরিয়াহ সূচক ১৫ দশমিক ৬৩ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে এক হাজার ২৪০ পয়েন্টে। আর ডিএস৩০ ৩১ দশমিক ০৮ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ১ হাজার ৯০১ পয়েন্টে।

মূল্যসূচক ও সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের দর বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে লেনদেনের পরিমাণ। দিনভর ডিএসইতে গতকাল লেনদেন হয়েছে ৫৩৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকার শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল ৪৭৫ কোটি ২৯ লাখ টাকার শেয়ার। সে হিসেবে লেনদেন বেড়েছে ৬০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আর দেড় মাস বা ৩০ কার্যদিবস পর ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ পাঁচশ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করতে পারল।

লেনদেনের উত্থানের দিনে বাজারে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের শেয়ার। মোট ১৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয় এদিন। ১৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনে দ্বিতীয় স্থানে ন্যাশনাল টিউবস এবং ১৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে ফরচুন সুজ।

এ ছাড়া লেনদেনের শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- মুন্নু সিরামকি, ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস, ন্যাশনাল পলিমার, জিনেক্স ইনসোসিস, অ্যাকটিভ ফাইন এবং এস্কয়ার নিট কম্পোজিট।

অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএসসিএক্স ২০৪ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৯৮৮ পয়েন্টে। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ২৮ কোটি ৩১ লাখ টাকার শেয়ার। লেনদেন অংশ নেয়া ২৫৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম বেড়েছে ২১৭টির, কমেছে ৩২টির আর অপরিবর্তিত রয়েছে ১০টির দাম।

সংবাদটি শেয়ার করুন

অর্থনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

অর্থনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :