উচ্ছেদের ঝুঁকিতে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি

প্রকাশ | ০৮ মে ২০১৯, ১১:২৮

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকাটাইমস

উচ্ছেদের ঝুঁকিতে পড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাস। জমি ভাড়া করে ভবন নির্মাণ করার পর টাকা পরিশোধ না করায় ক্ষেপেছে ‘মালিকপক্ষ’। হুমকি দিয়েছে উচ্ছেদের।

দুই পক্ষে বিরোধ চার কোটি টাকা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুরুর দিকে টাকা দিলেও দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে টাকা দিচ্ছে না। তারা বলছে, জমিটির প্রকৃত মালিক রাশিয়ার সরকার। তারা টাকা দিতে নিষেধ করেছে। একবার আবার চেকের মাধ্যমে সব টাকা পরিশোধের দাবি করেছে তারা।

অন্যদিকে যার কাছ থেকে জমিটি ইজারা নেওয়া হয়েছিল, সেই অশোক গুপ্তা পড়াশোনা করেছেন রাশিয়াতে। তিনি কাজ করেন সে দেশের সরকারের সঙ্গে। তিনি বলছেন, এই জমিটি রুশ সরকারের কাছ থেকে তিনি ২০০২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইজারা নিয়েছেন। আর ২০০৩ সালে তিনি প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া পরিশোধের শর্তে ব্যবহার করতে দেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিকে। তাদের সঙ্গেও চুক্তি নবায়ন করা হয় ২০১৬ সালে। এর মেয়াদ ২০২২ সাল পর্যন্ত।

অশোক গুপ্তা বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশন-বিটিসির স্বত্বাধিকারী। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই স্টামফোর্ডের ভাড়ার চুক্তি। অশোক গুপ্তার অভিযোগ, ২০১৭ সাল থেকে স্টামফোর্ড তাদের কোনো ভাড়া পরিশোধ করছে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাড়ার টাকা পরিশোধ করা না হলে তাদের উচ্ছেদ করা হবে। বর্তমানে ক্যাম্পাসটিতে প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টি চেয়ারম্যান ফাতিনাজ ফিরোজ বলেন, ‘জমির ভাড়ার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। তাও তারা (জমির মালিক পক্ষ) টাকা দাবি করছে।’

কীভাবে টাকা পরিশোধ করেছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। তবে সেগুলোর প্রমাণ এখন দেওয়া সম্ভব না।’

এই জমিটি নিয়ে স্টামফোর্ড আরও ‘মিথ্যাচার’ করেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। ২০১৬ সালে এই ক্যাম্পাসটিকেই স্থায়ী ক্যাম্পাস দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। পরে ইউজিসি তদন্ত করে জানতে পারে, তাদের দেখানো স্থায়ী ক্যাম্পাসটির জায়গার মালিক রাশিয়ার সরকার। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়টি রাশিয়া সরকারের সঙ্গে সরাসরি চুক্তিপত্র করেনি, তাই ৫১ সিদ্ধেশ্বরীর ক্যাম্পাসটিকে তারা ‘অস্থায়ী ক্যাম্পাস’ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাস ধানমন্ডি দেখিয়ে ‘সিটি ক্যাম্পাস’ হিসেবে সিদ্ধেশ্বরীর এই ভাড়া ভবনটি দেখায়।

নথিপত্র বলছে, রাশিয়া সরকারের অর্থনৈতিক জোনের জায়গাটি বিটিসি ২০০২ সালে ভাড়া নেয়। পরের বছর জায়গাটি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাড়া দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা দ্বন্দ¦ দেখা দিলে ভাড়া নিয়ে গড়িমসি শুরু হয়। তখন শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে দুই পক্ষকেই ডাকে ইউজিসি। ২০১৬ সালে ইউজিসি ভাড়া পরিশোধ করতে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দেয়। সে সময় ২০২২ সাল পর্যন্ত ইউজিসির অনুমতিক্রমে বিটিসি এবং স্টামফোর্ড পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি করে। সে মোতাবেক এক বছর ভাড়া পরিশোধ করা হলেও সে সময়ের চেয়ারম্যান হান্নান ফিরোজের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ফাতিনাজ ফিরোজ চেয়ারম্যান হন। তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেন। এতে চার কোটি টাকার বকেয়া জমা হয়।

বিটিসির স্বত্বাধিকারী অশোক গুপ্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ২০২২ সাল পর্যন্ত আমাদের ভাড়া চুক্তি হয়েছিল। প্রথম দিকে সে মোতাবেক ভাড়া ঠিকমতো পরিশোধ করা হলেও এখন সেটা করা হচ্ছে না। এ যাবৎ ভাড়ার চার কোটি টাকার ১৯টি চেক দিলেও সেগুলোতে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। প্রতিটি চেক ডিজঅনার হলে আমরা আদালতে মামলা করি। এ যাবৎ আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়টির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ১৯টি চেক জালিয়াতির মামলা করা হয়েছে। এই মামলা উঠিয়ে নিলে স্টামফোর্ড কর্তৃপক্ষ সব বকেয়া পরিশোধ করবে বলে আশ্বস্ত করে। আমরা পাঁচটি মামলা উঠিয়ে নিলেও তারা টাকা পরিশোধে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।’

অশোক গুপ্তা বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে আমরা ক্যাম্পাসটি উচ্ছেদ করিনি। কিন্তু তারা প্রতিনিয়ত ভাড়ার টাকা দিতে সময় নিচ্ছে। কিন্তু আমাদের রাশিয়ার কাছে ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে মোটা অংকের টাকা লোকসান দেখা দিয়েছে। জানতে পেরেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান বিভিন্ন জায়গায় বলছেন, আমাদের টাকা পরিশোধ করেছেন। আবার বলছে, রাশিয়ার সরকার তাদের (স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়) বলেছে টাকা পরিশোধ না করতে। আমার কথা হচ্ছে- বাংলাদেশে ২০০২ সালে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বিটিসির সঙ্গে চুক্তি বদ্ধ হয়েছিল। তাহলে কীভাবে রাশিয়া সরকার তাদের টাকা পরিশোধে নিষেধ করল। বিটিসি তো প্রতিনিয়ত টাকা পরিশোধ করছে রাশিয়ার সরকারকে। এসব প্রোপাগান্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আগেও ছড়ানো হয়েছিল। হান্নান ফিরোজ চেয়ারম্যান থাকাকালে ইউজিসির কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন সব টাকা পরিশোধ করবে। সেই সব কাগজও আমাদের কাছে আছে।’

বিটিসির আইন উপদেষ্টা কাজী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ভাড়া নিয়ে সম্প্রতি বিরোধ হওয়ায় আমরা ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সব সদস্যকে চিঠি দিয়েছি। চিঠিতে বলা হয়েছে- দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাড়া বাবদ পাওয়া চার কোটি টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে আমরা ক্যাম্পাসটি উচ্ছেদ করব। স্টামফোর্ড কর্তৃপক্ষ বকেয়া টাকা পরিশোধ করবে বলে আমাদের কাছ থেকে সময় নিয়েছে। কিন্তু সেটা পরিশোধ করছে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভাড়া নিয়ে বিরোধ তৈরি করে সরাসরি রাশিয়া থেকে জমি ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতেও তারা সফল হয়নি।’

জমি নিয়ে বিরোধের কারণে সিদ্ধেশ্বরীর সিটি ক্যাম্পাসটির বন্ধ হলে বিপাকে পড়বে প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী। এই নিয়ে শঙ্কায় শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আজহারুল ইসলাম শোভন বলেন, ‘দুই-তিন মাস পর পর এমন নিউজ হয়। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের কাছে লজ্জায় পরে যাই। এটার সুষ্ঠু সমাধান হওয়া দরকার।’

মিনহাজুল ইসলাম নামে বিবিএ এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘টাকা নিয়ে যে বিরোধ সেটার সমাধান করা উচিত। আমরা তো টাকা দিয়ে পড়ছি। যদি কোনো কারণে ক্যাম্পাসটি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পরব। কারণ টিউশন ফি ঠিকমতো দেওয়ার পরও এমন সংবাদ খুবই লজ্জার।’

ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপ-পরিচালক আমিরুল ইসলাম শেখ ঢাকা টাইমস কে বলেন, ‘আমি মাত্র কয়েকদিন এই পদে নতুন যোগদান করেছি। তাদের একটা বিরোধের কথা শুনেছি। তবে বিষয়টি আগে জানতে হবে, তারপর বলতে পারব।’

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান ফাতিনাজ ফিরোজ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত টাকা দিই। কিন্তু তারা হঠাৎ বলছে টাকা পাচ্ছে না। চেকের মাধ্যমে প্রতি মাসের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।’

(ঢাকাটাইমস/৮মে/এসএস)