নিজেই ধুঁকছে ভোক্তা অধিদপ্তর

তানিয়া আক্তার, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১২ মে ২০১৯, ১২:০২
ফাইল ছবি

প্রতারিত ভোক্তাদের পাশে দাঁড়ানো যাদের দায়িত্ব, তারা নিজেরাই আছে সংকটে। অপর্যাপ্ত জনবল আর সুযোগ-সুবিধার অভাবে অভিযোগকারী ভোক্তাদের প্রতিকারের ব্যবস্থাও করতে পারছে না তারা।

ওজনে কারচুপি, মানহীন আর একটি দেখিয়ে আরেকটি পণ্য বা সেবা বিক্রির প্রবণতা নতুন নয়। তবে প্রতারিত ভোক্তারা অভিযোগ করতে পারবেন, এমন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না এক দশক আগেও। তবে ২০১০ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গঠনের পর থেকে সেখানে অভিযোগ করার সুযোগ মিলছে। আর শুনানিতে প্রমাণ হলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ারও সুযোগ থাকছে অভিযোগকারীদের। কারণ, যে জরিমানা হয় তার ২৫ শতাংশ নগদে পান অভিযোগকারী।

অধিদপ্তর এক দশক ধরেই নানা অভিযোগের শুনানি করে সিদ্ধান্ত দিয়ে আসছে। আর আগের তুলনায় অভিযোগের সংখ্যা আর নিষ্পত্তির হারও বাড়ছে। তবে নিজেদের কাজে নিজেরাই সন্তুষ্ট নয় অধিদপ্তর। কারণ, তাদের যতটা করার কথা, সেটা করতে পারছে না। আর এর পেছনে অবকাঠামোগত দুর্বলতাকেই দায়ী করছেন কর্মকর্তারা।

এখন পর্যন্ত ভোক্তার প্রতিকার লাভের সুযোগ রাজধানী বা কয়েকটি বড় শহরে আছে। উপজেলা এমনকি বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে কোনো কার্যালয় নেই যেখানে গিয়ে ভোক্তারা অভিযোগ করতে পারবে।

অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নেই। অনেক ক্ষেত্রেই বিলম্বের কারণে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না।

আবার কোনো পণ্যে ভেজাল আছে কি না, সেটা পরীক্ষার জন্য অধিদপ্তরের নিজস্ব কোনো পরীক্ষাগার নেই। সায়েন্স ল্যাবরেটরির পরীক্ষাগার তাদের ভরসা। কিন্তু সেখানে অন্য কাজ হয় বলে সিরিয়াল পাওয়া কঠিন। এতেও অনেক সময় অভিযোগের প্রমাণ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

আবার জেলা পর্যায় থেকে নমুনা পাঠানো বা ফলাফল নিয়ে আসতে বা অভিযানে যেতে নিজস্ব গাড়ি নেই। যানবাহনের অভাবে অনেক উদ্যোগ প্রায়ই আটকে গেছে। অভিযানেও যাওয়া হয়নি সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েও।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্কর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের এখনো বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। অভিযোগ নেয়ার পর নিজস্ব গবেষণাগার না থাকায় সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিসিএসআইআরে যেতে হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে নিজস্ব যানবাহন না থাকায় সময় যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি অভিযোগকারীর কাছেও দ্রুত পৌঁছতে পারছি না।’

‘হেডকোয়ার্টারে এবং প্রত্যেকটা বিভাগে গবেষণাগার দরকার। গবেষণাগার হলে ভেজালদ্রব্য নির্ণয় করতে সুবিধা হবে।’

মহাপরিচালক বলেন, ‘আমাদের লোকবলও প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম। জেলা পর্যায়ে এখনো ১৮ জন কর্মকর্তা নেই। উপজেলা পর্যায়ে এখনো অফিস এবং জনবল নেই। অধিক জনবল না থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত যেতে পারছি না। প্রত্যেক জেলায় গাড়ি নেই। প্রতিদিন ভাড়ায় চালিত গাড়ি দিয়ে অভিযানে বিলম্ব হয়। অনেক সময় গাড়ি পাওয়াও যায় না।’

অনলাইনেও অভিযোগ করার সুযোগ আছে প্রতারিত ভোক্তার। তবে সেখানেও পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, ‘প্রযুক্তির যুগে এখন পর্যন্ত সব কিছু ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে না। সরকারিভাবে এখনো কোনো অ্যাপ নেই ভোক্তা অধিকারের সেবা নিয়ে। যদিও অনলাইনে নিউজ হলে বা ফেসবুকে কোন অভিযোগ এল কিনা সদস্যরা সেদিকে নজর রাখেন।’

আইনি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভোক্তারা প্রতারিত হলেও বেশ কিছু পণ্য বা সেবা নিয়ে অভিযোগ করতে পারেন না। যেমনÑ হাসপাতালের সেবা নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগের সুযোগ রহিত করা হয়েছে আইনে।

মহাপরিচালক বলেন, ‘ট্রান্সপোর্ট, টেলিকমিনিউকেশন, গ্যাস, ইলেক্ট্রিসিটি, ওয়াটার সাপ্লাই, সুয়ারেজ, কনস্ট্রাকশন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট এবং হেলথ সার্ভিস এমন ১০টি ক্যাটাগরি আছে এখন পর্যন্ত। কিন্তু কেউ বিউটি পার্লারে ভালো সেবা পাচ্ছে না, লন্ড্রিতে কাপড় পাঠানোর পর ছিঁড়ে গেছে, টেইলারিংয়ে দামি কাপড় নষ্ট করে দিল- এসব অভিযোগ আমাদের কাছে আসে। কিন্তু আমাদের কিছু করার থাকে না। কারণ, আইনে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। মোবাইল ব্যাকিংসহ আরও সার্ভিসে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তারও প্রতিকারের সুযোগ নেই। যেসব সেবা নিয়ে অভিযোগ করা যাবে, সেটি ১০টি থেকে বাড়িয়ে ৩০টার মতো হওয়া দরকার।’

আইনে না থাকায় রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগের নিষ্পত্তিও কঠিন। সম্প্রতি পাঠাওয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে যে, একই দূরত্বের ভাড়া কখনো ৫০০ টাকা আবার কখনো বেশি দেখাচ্ছে। কিন্তু এর প্রতিকার করা যায়নি।

কয়েকটি মোবাইল কোম্পানির বিরুদ্ধে বিশাল অংকের অভিযোগ করলেও তারা আদালতে রিট করায় সেগুলো নিষ্পত্তি করায় জটিলতা দেখা দিয়েছে।

মহাপরিচালক বলেন, ‘মোবাইল ফোন কোম্পানির বিরুদ্ধে কল রেট বেশি রাখার অভিযোগ আসে। গ্রামীণফোনকে দুই লাখ টাকা এবং রবিকে সাড়ে তিন লাখ টাকা জরিমানা করার পর তারা আদালতে রিট করেছে। এভাবে রিট করায় মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।’

আবার এক মাসের মধ্যে অভিযোগ না করলে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এক মাসের মধ্যে জানতে নাও পারেন। আবার জানলেও ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তার অভিযোগ করার মতো শারীরিক অবস্থাও না থাকতে পারে।

জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে সচেতনতার অভাবও একটি কারণ। তিনি বলেন, ‘শহুরে শিক্ষিত মানুষের কিছু অংশ ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে জানে। আর গ্রাম পর্যায়ে নকল পণ্য বা পণ্যের দাম নিয়ে অনেক ভোক্তাদের বিড়ম্বনা বেশি তাই উপজেলা পর্যায়ে যেতে না পারায় ভোক্তারা আরও ভুক্তভোগী হচ্ছেন।’

অধিদপ্তরের এতসব সমস্যার কথা জেনে মর্মাহত হয়েছেন ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘যারা ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করছে, তাদের পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার। তবে এই বিষয়টি নিয়ে এত হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তারা কাজ করছে আর ভোক্তারাও আগের চেয়ে সচেতন হচ্ছে। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাব, তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিক, যেন তারা আরও দক্ষতার সঙ্গে ভোক্তার পাশে দাঁড়াতে পারে।’

অভিযোগ বাড়ছে

২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন পাস হয় আর ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল আইনটির বাস্তবায়ন শুরু করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গত ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫২ হাজার ১০৮টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভোক্তা ঠকানোয় জরিমানা করা হয়েছে।

অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১০ থেকে গত ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতারিত ভোক্তার ২১ হাজার ১৮৯টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে ১৮ হাজার ৮০৯টি। তদন্ত চলছে বাকি দুই হাজার ৩৮০টি।

আইন অনুযায়ী অভিযোগ প্রমাণিত হলে যে জরিমানা হয় তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী পেয়ে থাকেন। যেসব মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে, তাতে জরিমানা হয়েছে ৪১ কোটি ১৫ লাখ এক হাজার টাকা। এর মধ্যে ভোক্তার অভিযোগে জরিমানা হয়েছে ৩০ কোটির মতো। আর অভিযোগকারীরা পেয়েছেন ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪২৭ টাকা।

অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, প্রথম তিন বছরে খুব বেশি অভিযোগ জমা পড়েনি। তবে যে কটি জমা পড়েছে, নিষ্পত্তি হয়েছে তার সব কটি।

২০১০ থেকে ২০১৩ অর্থবছরে অভিযোগ জমা পড়ে ১৭৯টি। ১৭ জন অভিযোগকারী পেয়েছেন ৫১ হাজার ৫০০ টাকা।

এর পরের প্রতি বছরই বাড়ছে অভিযোগ আর অভিযোগকারীর সংখ্যা। ২০১৪-১৫ সালে অভিযোগ জমা পড়ে ২৬৪টি। নিষ্পত্তি হয় সব কটি। এদের মধ্যে ১০৭ জন অভিযোগকারী ২৫ শতাংশ হিসেবে পেয়েছেন এক লাখ ৮৮ হাজার ৫০০ টাকা।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে অভিযোগ জমা পড়ে ৬৬২টি। অভিযোগকারীদের মধ্যে ১৯২ জন জরিমানার ২৫ শতাংশ হিসেবে পেয়েছেন দুই লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৫ টাকা।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় দশ গুণ। সে সময় ছয় হাজার ১৪০টি অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয় সব কটি। আর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া এক হাজার ৪১৬ জন ভোক্তা জরিমানার ২৫ শতাংশ হিসেবে পেয়েছেন ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৭৭ টাকা।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে অভিযোগের সংখ্যা আরও প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ে। ওই বছর জমা পড়ে নয় হাজার ১৯টি অভিযোগ। নিষ্পত্তি হয় সব কটি। আর প্রমাণিত হওয়ার পর এক হাজার ৯৩৪ জন অভিযোগকারী জরিমানার ২৫ শতাংশ হিসেবে পেয়েছেন ৩৯ লাখ ৭২ হাজার টাকা।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত অভিযোগ জমা পড়েছে চার হাজার ৯২৫টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে দুই হাজার ৫৪৫টি। তদন্ত চলছে দুই হাজার ৩৮০টির। আর চলতি বছর এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ৮৩১ জন অভিযোগকারী জরিমানার ২৫ শতাংশ হিসেবে পেয়েছেন ১৩ লাখ ৩৯ হাজার ৬২৫ টাকা।

তবে এখন পর্যন্ত অভিযোগ যা জমা পড়েছে তার সিংহভাগই রাজধানীর। ঢাকার বাইরে এখনো অভিযোগ দেওয়ার হার কম। আর সেখানে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টাও চলছে।

(ঢাকাটাইমস/১২মে/টিএ/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

নাথান বমের স্ত্রী কোথায়

চালের বস্তায় জাত-দাম লিখতে গড়িমসি

গুলিস্তান আন্ডারপাসে অপরিকল্পিত পাতাল মার্কেট অতি অগ্নিঝুঁকিতে 

সিদ্ধেশ্বরীতে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু: তিন মাস পেরিয়ে গেলেও অন্ধকারে পুলিশ

রং মাখানো তুলি কাগজ ছুঁলেই হয়ে উঠছে একেকটা তিমিরবিনাশি গল্প

ঈদের আনন্দ ছোঁয়নি তাদের, নেই বাড়ি ফেরার তাড়া

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :