‘তোরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি বেটা’

প্রকাশ | ১২ মে ২০১৯, ১৯:১৮

হাফিজুর রহমান

বরাবরই একটু স্বাধীনচেতা আমি।যা ভালো লাগে,যা মনে সায় দেয় সেটা করতে এতোটুকু দেরী করিনা।এতে হয়তো এ যাবত কোন ক্ষতি হয়নি তবে ভবিষ্যতের কথা তো আর বলতে পারিনা!আমার এই স্বাধীনচেতা মনোভাবকে আম্মাও দেখতাম সবসময় প্রশ্রয় দিতেন।কখনো কিছু করতে চাইলে আম্মা বলতেন –‘দ্যাখ মন কি বলে'।

আমি বলতাম –‘মনতো গ্রিন সিগনাল দিছে আম্মা।আম্মা স্বভাবসুলভ হাসিতে শুধু এটুকু বলতেন-‘পাগল ছেলে আমার’। এই কথাটাই যে বিশাল বড় দোয়া,আশীর্বাদ আর ভালোবাসার মিশেলে এক অনবদ্য সফলতা তা চোখ বন্ধ করলেই বুঝতাম।

২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে চান্স পেলাম।ক্লাশ শুরু হওয়ার পরে মনটা বিগড়ে গেল।ভাবলাম পড়বো না আইনে।আমার এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে সবাই আমাকে গোবর গণেশ,ঢাকের কাঠি,অঘারামসহ বাগধারীয় কায়দা-বেকায়দায় বেমালুম গালমন্দ করলেন।আমি বাড়ি গেলাম।

কিন্তু আম্মাকে তখন ঠাকুরগাঁওয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।একদিন পরেই আম্মার অপারেশন।মনটা খারাপ হয়ে গেল।আম্মা আমাকে দেখেই আস্তে করে বললেন-কিরে বাবু মন খারাপ নাকি'আমি না বলতেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-‘বল আমাকে কী হয়েছে।’

আম্মাকে সব খুলে বলার একটু পরেই আম্মাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেল।ঠিক সেই মুহুর্তে আম্মা বললেন- আমি জানি বাবু আইনে পড়েও তুই যা করবি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়েলেও তুই তাই করবি,ভালো না লাগলে আইনে পড়ার দরকার নাই।'

আমি আম্মার কথা রেখেছি।আম্মার আস্থার মর্যাদা দিয়েছি।৩০ তম বিসিএসের ফলাফল নিয়ে যেদিন বাসায় গেলাম সেদিন আম্মা ছলছল চোখে সবাইকে বললেন- 'তোমরা শুধু শুধু রিয়েলকে বকা দিছিলা, দেখলেতো ও কিন্তু ঠিকই ভালো করেছে।আমার ছেলেকে আমি চিনি।'

এভাবে প্রতিটা ক্ষেত্রে আম্মা সাহস দিয়েছেন।প্রেরণা যুগিয়েছেন।মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে দোয়া করেছেন।এইতো কিছুদিন আগেও বাড়ি গিয়েছিলাম।আম্মা আমার উস্কোখুস্কো চুল দেখে বললেন-' নিজের দিকে খেয়াল করিসনা ক্যানরে বাবু,তোর চুলের অবস্থা এরকম হইছে ক্যান' বলেই এক মিনিটের মধ্যেই মাথাটা নারিকেল তেলের ফ্যাক্টরি বানিয়ে ফেললেন।

একটু আগেই আম্মার সাথে ফোনে কথা হলো।মা দিবসের কথা বলতেই হাসলেন আম্মা।বললেন প্রতিটা দিনই তো মায়ের দিন বাবু।

আমি বললাম- ‘আম্মা আল্লাহতালা তোমাকে সুস্থভাবে আরো একশত বছর বাঁচিয়ে রাখুক,তোমাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসি আম্মা।তুমি আমাদের সব।সবসময় ভালো থাকো আম্মা।নিজের দিকে খেয়াল রেখো।'

আম্মা কাঁদছেন।বুঝতে পারছি।শুধু এটুকু বললেন,তোরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো বেটা,তোরাই তো আমার ভালোলাগা বাবু।বেঁচেই আছি তোদের জন্য''

চোখ ভিজে ওঠে আমার।অজান্তেই বিড়বিড় করে বলে উঠি- 'তুমি এতো ভালো কেন আম্মা’।

লেখক: অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার,

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।