সিম জালিয়াতিতে রবি

প্রকাশ | ১৬ মে ২০১৯, ১০:১২

কাজী রফিক

একটি জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে সর্বোচ্চ ১৫টি সিম নিবন্ধন করা গেলেও বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর রবি এক হাজার ৫২১টি সিম নিবন্ধন করেছে। আর এই কাজটি করা হয়েছে যার পরিচয়পত্র, তার অজান্তে। ওই ব্যক্তির কাছে মোট ২১টি সিম ছিল। বাকি সিমগুলো অন্যরা ব্যবহার করছেন।

এই ২১টি সিমের মধ্যে ছয়টি সিম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রবির এই জালিয়াতির কথা জানতে পারেন ভুক্তভোগী সজিব সরকার। যেসব সিম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তার একটিতে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বিকাশে নিবন্ধন করা। আর সেই নম্বরেই তার অফিস থেকে বেতন পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তিনি টাকা তুলতে পারছেন না। আর সেই সিম চালু করতে গিয়েই বিস্ময়কর এই ঘটনা জানতে পারেন তিনি।

আরও বিস্ময়কর হচ্ছে, সজিব রবির গুলশান কাস্টমার কেয়ার অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছেন, তার নামে দুটি করপোরেট সিম নিবন্ধন করা আছে। কিন্তু তিনি নিজে সে নম্বর দুটি বন্ধ করতে পারেননি।

সজিব সরকারের নামে যে ১৫১৯টি সিমের নিবন্ধন রয়েছে, এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ ঢাকা টাইমসের হাতে রয়েছে।

রবির কাস্টমার কেয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সুপারভাইজার মাইনুদ্দিন পরিচয়ে একজন বলেন, এক জনের নামে ১৫টির বেশি সিম নিবন্ধনের সুযোগ নেই। সজিবের নামে এক হাজার ৫১৯টি সিম নিবন্ধনের তথ্য জানালে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। বলেন, এ বিষয়ে জানতে হলে তাদের প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ বিভাগে ই মেইল করতে হবে। আর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দেওয়া হবে।

যোগাযোগ করা হলে রবির এক্সটারনাল কমিউনিকেশনস বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার আশিকুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, সব প্রমাণ দিলে তিনি কথা বলতে পারবেন। তার আগে নয়। তিনি বারবারই সজিবের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দেওয়ার অনুরোধ করছিলেন।

কিছুক্ষণ পর ফোন করে আশিকুর রহমান কল করে তাকে অফিস সময়ে কেন এই তথ্য জানানো হয়নি, সেই বিষয়টি বারবার বলছিলেন। এই সিম জালিয়াতির তথ্য প্রমাণ তাদের দিতে চাপাচাপিও করছিলেন। এক পর্যায়ে বলেন, যদি তথ্য প্রমাণ ভুল প্রমাণ হয় তাহলে তারা চ্যালেঞ্জ করবেন।

সজিব দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় আগে রবি এবং টেলি যোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বিটিআরসির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

গত ১ মে তারিখ হঠাৎ করেই দুটি সিম বন্ধ হয়ে যায় সজিবের। বন্ধ হয়ে যাওয়া সিম কার্ড সচল করতে সজিব যোগাযোগ করেন রবির কাস্টমার কেয়ারে। তার আগে মোবাইল ফোনে *১৬০০# নম্বরে এসএমএসের মাধ্যমে তার নামে নিবন্ধিত সিমের তালিকা বের করেন। তালিকায় সজিবের নামে ২১টি সিম দেখানো হয়।

এসএমএস এ নিবন্ধিত নম্বরের প্রথম ও শেষ তিনটি করে ডিজিট দেখানো হয়। এর মধ্যে দুটি নম্বর অপরিচিত মনে হয় সজিবের কাছে। নম্বর দুটির বিস্তারিত জানতে রবির একটি কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে যান। সেখানকার কর্মকর্তা তাকে জানান, তার জাতীয় পরিচয়পত্রে এক হাজার ৫১৯টি সিম নিবন্ধন করা আছে। সেখান থেকে এই দুটি নম্বর খুঁজে বের করার সময় এই মুহূর্তে তাদের কাছে নেই।

এরপর নিজের নামে নিবন্ধিত সিমের ১ হাজার ৫১৯টি নম্বরের তালিকা বের করেন সজিব। সেখান থেকে ওই অপরিচিত নম্বর দুটি বন্ধ করতে গত ৫ মে সকালে আবার রবির গুলশানের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে যান। সেখান থেকে তাকে জানানো হয়, দুটি সিম একটি প্রতিষ্ঠানে করপোরেট গ্রাহকরা ব্যবহার করছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছাড়া তা বন্ধ করা যাবে না।

বিষয়টি নিয়ে রবির প্রতি ক্ষুদ্ধ এই যুবক। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমার এনআইডিতে সিম নিবন্ধন করতে হলে তো আমার ফিঙ্গার প্রিন্ট (আঙুলের ছাপ) লাগার কথা। কিন্তু আমি তো এতগুলো সিম কখনোই নিবন্ধন করিনি। আমার নামে সিম থাকার কথা ২১টা।’

‘বিটিআরসির নিয়ম অনুসারে একজনের নামে তো এতগুলো সিম থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তারা একজনের এনআইডিতে কীভাবে এতগুলো সিম নিবন্ধন দেয়?’

তার নামে নিবন্ধিত সিম বন্ধ করতে চাইলে সে বিষয়ে রবি কেন আপত্তি করবে, সেটা বুঝতে পারছেন না সজিব। বলেন, ‘আমার নামে যে সিম দেখাচ্ছে আমি সেখান থেকে দুটি সিম বন্ধ করতে চাইলাম। কারণ আমি ওই নম্বরগুলো চিনি না। কিন্তু তারা (রবির কাস্টমার কেয়ারের কর্মকর্তারা) বলছে, সেগুলো করপোরেট সিম। তারা এগুলো বন্ধ করতে পারবে না।’

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) হেল্প লাইনেও যোগাযোগ করেছেন এই যুবক। গত ২ মে থেকে ৯ মে তারিখ পর্যন্ত বিটিআরসিতে যোগাযোগ করেও সমাধান মেলেনি বলে জানান সজিব সরকার। বলেন, ‘আমি বিটিআরসি এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার ফোন করেছি। তারা বলল, তারা রবির সাথে কথা বলবে। সমস্যা সমাধান হবে। কিন্তু কোনো সমাধান পাচ্ছি না।’

বন্ধ হয়ে যাওয়া সিমের মধ্যে তিনটি সিম সচল করতে বিটিআরসির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন সজিব। ১০-১২ বার বিটিআরসি হেল্পলাইন নম্বর ১০০ তে ফোন করে অনুরোধ করা হলেও তার সিমগুলো সচল করা হয়নি বলে তিনি জানান।

সজিব জানান, তার বন্ধ হয়ে যাওয়া সিমে বিকাশ ও রকেট এর অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সিম বন্ধ থাকায় তিনি আর্থিক লেনদেন করতে পারছেন না। এমনকি তাকে দেওয়া বেতনও তুলতে পারছেন না।

সজিব জানান, বিটিআরসিতে যোগাযোগ করা হলে তাকে বলা হয়, তার নামে নিবন্ধিত সিমের কোটা খালি হলে অর্থাৎ নিবন্ধিত সিমের পরিমাণ ১৫টির নিচে নামিয়ে আনলে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিমগুলো সচল করে দেয়া হবে। অথচ নিবন্ধিত সচল সিমের মধ্যে অন্য অপারেটরের দুটি সিম বন্ধ করার পরেও তার নামে নিবন্ধিত সিমগুলো সচল করা হয়নি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর জনসংযোগ কর্মকর্তা জাকির হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘যে কোনো টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান যদি এ ধরনের অনিয়ম করে থাকে তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হলে রবির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর যে গ্রাহকের নামে সিম নিবন্ধন হয়েছে তার সমস্যাও সমাধান করা হবে।’