কাউকে দেখলে কোনদিন ভুলতেন না বঙ্গবন্ধু

প্রকাশ | ১৬ মে ২০১৯, ১২:১৯

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু

বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা রাত্রি পর্যন্ত ছিল বাবার চাকরি জীবনের স্বর্ণযুগ। এই সময়টুকু তিনি বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহান নেতার পাশে থেকে বাবার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবার কাছে জাতির পিতা ছিলেন একজন নেতা যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে শুধুমাত্র দেশ আর দেশের জনগণের কথা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। বঙ্গবন্ধুর সহচর্যে থাকাকালীন ঘটে যাওয়া অনেক খণ্ড খণ্ড ঘটনা আজ অনেকেরই অজানা। বাবার কাছে শোনা এসব কথার কিছু কিছু অংশ আমি এখানে তুলে ধরছি।

বঙ্গবন্ধুর অসীম স্মরণ শক্তি ছিল। একবার কাউকে দেখলে কোনদিন ভুলতে পারতেন না। একদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গণভবনে দেখা করার জন্য একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক আসেন। তার পড়নে ছিল লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। গেটে পাহারারত পুলিশ বৃদ্ধ ভদ্রলোককে গণভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি। ফলে ভদ্রলোক গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এমন সময় বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বাবা গণভবনের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছিলেন। বাবা তখন বঙ্গবন্ধুর কালো মার্সেটিসের সামনের আসনে বসা। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে গেটের একপাশে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে বঙ্গবন্ধু গাড়ি থামাতে বলেন। পরে তিনি নিজে গাড়ি থেকে নেমে ভদ্রলোককে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের পাশে বসিয়ে গণভবনের নিয়ে আসেন।

গণভবনে ভেতরে একটি রুমে কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু বৃদ্ধ ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে বাহিরে বারান্দায় গিয়ে উপস্থিত সকলকে বললেন, আপনারা এই ভদ্রলোককে গণভবনের ভেতরে ঢুকতে বাধা দিয়েছেন। কারণ তার অতীত আপনাদের জানা নেইl কিন্তু আমার কাছে তিনি অত্যন্ত প্রিয় ও মূল্যবান ব্যক্তি। পাকিস্তানী পুলিশ যখন আমাকে গ্রেপ্তারের জন্য হন্য হয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছিল তখন তিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে আমাকে তার বাসায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনি আমার কাছে আজ কিছু চাইতে আসেননি। তার কাছে আমি অনেক ঋণী। তার এই ভালবাসার কথা, তার এই উপকারের কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। তবে তার বর্তমান অবস্থা দেখে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। এই বলে তিনি তোফায়েল ভাইকে (বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব) ডেকে ভদ্রলোককে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। এই হলেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় সফরে কুয়েত, মিশর ও ইরাক ভ্রমণে যাওয়ার সময় বাবাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। এইসময় বঙ্গবন্ধু কুয়েত, মিশর, ইরাক এই তিনটি দেশ একসঙ্গে সফর করেছিলেন। কুয়েতে নেতার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। এখানে একটি রুমে সোনার পালংকে নেতার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই সময় সারা দিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন বিছানায় এলিয়ে পরতেন তখন নেতার গায়ের বিভিন্ন স্থানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হতো। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার মহিউদ্দিন ভাই (এখনো জীবিত) তখন নেতার হাত পা টিপে দিতেন। নেতার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও কাছের মানুষ ছিলেন মহিউদ্দিন ভাই। পাকিস্তান আমল থেকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সিকিউরিটি অফিসার ছিলেন মহিউদ্দিন ভাইl বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সময় মঞ্চে নেতার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। জানিনা বর্তমানে তিনি কোথায় কি অবস্থায় আছেন।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে বঙ্গবন্ধুকে বিছানায় এভাবে হাত পা টিপতে দেখে কুয়েতী নিরাপত্তাদের একজন বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওনার শরীর কি খারাপ? বাবা বললেন, না খারাপ হবে কেন? তবে বিভিন্ন সময় পাকিস্তনের কারাগারে থাকাকালীন তার উপর নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এই কারণে ওনার শরীরে মাঝে মধ্যে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত করে। তাই ওনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার ওনাকে মেসেজ করে দিচ্ছেন।

একসময় নামাজ পড়ার সময় হলে বাবা আকারে ইঙ্গিতে তাদের বুঝাতে চাইলেন পবিত্র কাবা শরিফ কোন দিকে। সাধারণ  সৈনিকরা বাবার কথা বুঝতে পারছিল না। কারণ তারা ইংরেজি জানে না। উপায় না দেখে বাবা আল্লাহ আকবর, আল্লাহ আকবর তাকবির পড়া শুরু করে দিলে অন্যান্য সিকিউরিটিরা এসে বাবাকে চুমু খেতে শুরু করে, আর বলতে থাকে মুসলমান মুসলমান। ততক্ষনাৎ তারা বাবাকে কাবা শরীফের মুখ দেখিয়ে দেয়। বাবার নামাজ পড়া শেষ হলে বাবা একজন অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা এমন করলেন কেন? ব্যাপার কি? উত্তরে কুয়েতি অফিসার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ হিন্দু দেশ হয়ে গেছে। ওখানে সকল মুসলমানদের মেরে ফেলা হয়েছে। আর যারা আছে তাদের অবস্থাও নাকি খুবই খারাপ। বাবাকে মুসলমান দেখে তারা আশ্চর্য হয়েছে এবং এইজন্য চুমু খেয়ে সহানুভূতি জানাচ্ছে।

বাবা তাদের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। বাবা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে বলেছে আপনাদের এসকল কথা। কোথা থেকে শুনেছেন আপনারা এসকল মিথ্যা কথা? সিকিউরিটিরা বললো, আমরা রেডিওতে শুনেছি। পরে জানা গেল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর মিডিয়া ও জামায়েত নেতা গোলাম আজম সারা মুসলিম বিশ্বে অপপ্রচার করেছে বাংলাদেশ এখন নাকি একটা হিন্দু দেশ হয়ে গেছে। ওখানে প্রায় সকল মুসলমানদের মেরে ফেলা হয়েছে ও হচ্ছে। মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুই শুনলেন বাবা তাদের মুখে।

তারপর বাবা বললেন, আপনারা মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন। আপনারা যা শুনেছেন সবই মিথ্যা কথা। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে বলা হয় সিটি অফ মস্ক। এখানে প্রতিটি কদমে কদমে রয়েছে মসজিদ। আপনারা পাকিস্তান ও তাদের সহযোগিতাকারী বাঙালি দালালদের দ্বারা মিথ্যার শিকার হয়েছেন। বাবা বললেন বাংলাদেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হলেও এদেশে শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ মুসলমান। আমরা এখানে যারা এসেছি সকলেই মুসলমান।

পরে শোনা গেল বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর জামায়াত নেতা গোলাম আজমকে পাকিস্তান সরকার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর জন্য সৌদি আরবে প্রেরণ করেছিল। সেখান থেকে তিনি সারা মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানের দূত গোলাম আজমের এই অপপ্রচারে কুয়েত, মিশর, ইরাক, ইরান, ইউনাইটেড আরব আমিরাতসহ অন্যান্য সকল মুসলিম দেশ কর্ণপাত না করলেও সৌদি আরব বঙ্গবন্ধু সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তারা বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোস্তাক সরকার ও সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই গোলাম আজমকে জিয়াউর রহমান পরবর্তিতে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দিয়ে তার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।