অসহায় হলেও এরাতো মানুষ!
বসুন্ধরা ইসলামী রিসার্চ সেন্টার বড় মসজিদ থেকে তারাবিহ্ নামাজ শেষে ১১টার দিকে বাসায় ফিরছি। ঠিক বাসার কাছেই দেখলাম বেশ জটলা একটি কিশোরী মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটির বয়স ১২-১৩ বছর হবে, একটা ভ্যান গাড়িতে শুয়ে আছে। আশপাশের লোকজনের কাছে যা শুনলাম তা হলো, গতরাত থেকে মেয়েটিকে এই এলাকায় দেখা গেছে। সে কথা বলতে পারে। তার নাম উর্মি। কিন্তু ঠিকানা বা পরিবারের কথা কিছু বলতে পারে না। তাকে সেরকম পাগলও মনে হচ্ছে না। ইতিমধ্যে ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়া অ্যাপোলো হাসপাতালের সাহাদৎ হোসাইন ৯৯৯ এ কল করেছে। জানালো ভাটারা থানা থেকে পুলিশ আসছে। আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু খাবে কি না। সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। আমি দ্রুত বাসা থেকে একটা প্লেটে কিছু বিরিয়ানি আর এক বোতল পানি নিয়ে গেলাম। দেবার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া শুরু করলো। মনে হচ্ছে বেশ খিদে পেয়েছিলে মেয়েটির।
ইতিমধ্যে ভাটারা থানা থেকে পুলিশ এসেছে দুজন। পুলিশকে দেখে মেয়েটি একটা অটোতে উঠে বসলো। তাদের সঙ্গে যেতে আগ্রহী। কিন্তু পুলিশের বক্তব্য, এ মেয়েটিতো পাগল। তাকে থানায় নেয়া যাবে না। আমি তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললাম। বোঝাতে চেষ্টা করলাম হয়তো কোনো সমস্যা হয়ে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। তবে সঠিক চিকিৎসা ও শশ্রুষা করলে হয়তো তার ঠিকানা খুঁজে বের করা যাবে। তাকে পরিবারের কাছে পাঠানো যাবে। আপনারা কোন এক আশ্রয় কেন্দ্রে রাখার একটু ব্যবস্থা করুন। ওর আত্মীয় স্বজন খুঁজে পেতে প্রয়োজনে আমরা হেল্প করবো। এই বয়সী কিশোরী মেয়েটিকে এতো রাতে এভাবে রাস্তায় ছেড়ে দেয়া কি ঠিক হবে?
কিন্তু অভিভাবকহীন এই মেয়েকে তারা নিতে আগ্রহী নয়। আমার একজন প্রিয় মানুষ যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী ওয়াজেদ ভাইকে তিনবার কল দিলাম। তিনি এসব বিষয়ে বরাবরই মানবিক। ওয়াজেদ ভাই পরামর্শ দিলেন তেঁজগাওস্থ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠালে হয়তো একটা ব্যবস্থা হবে। পাগলদের সেবা করে, অভিভাবকদের ঠিকানা বের করে দেয় এমন একজন দরদী মানুষের কথাও বললেন যে তাকে তিনি বিষয়টি জানাবেন। কিন্তু ভাটারা থানার পুলিশের বক্তব্য, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে কাউকে পাঠাতে হলে মামলা লাগে। তাছাড়া নির্যাতিত হতে হয়।
অবশেষে ফোন দিলাম জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মুহিত কামাল স্যারকে। মেসেঞ্জারে ছবিও পাঠালাম। তিনি বললেন, কোনো অভিভাবক ছাড়া কোন মানসিক রোগীকে ওখানে ভর্তি নেয়া হয় না। সেটাও দিনের বেলায় হতে হবে। আরো দুই একটি আশ্রয় কেন্দ্রের নাম্বার যোগার করে কল দিলাম, কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না এতো রাতে। এক পর্যায়ে থানা থেকে আসা এক পুলিশ আমাকে বললো, 'ইচ্ছে করলে আপনার বাসায় রাখতে পারেন রাতটা, কাল দেখা যাবে।' আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার বাসাতেই থাকুক। গোসল করে ভালো কাপড় পড়িয়ে খাবার খেয়ে ভালো একটা ঘুম হলে মেয়েটি হয়তো অনেকটাই সুস্থ হয়ে যাবে। প্রয়োজনে আজ রাত জেগে পাহারা দিবো যাতে কোন সমস্যা না হয়।
আমার স্ত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে কল দিলাম। পুলিশের লোকজন মেয়েটিকে অটো গাড়ি থেকে নামতে বললো। কিন্তু মেয়েটি নামবে না। কোনোমতেই বাসার মেইন গেটের ভেতর ঢোকানো গেল না। বুঝলাম, বাসা ভীতি কাজ করছে! সে দৌড়ে অন্য দিকে চলে গেল। পুলিশও মেয়েটিকে এভাবে রেখেই থানায় চলে গেল। জটলার মধ্যেই বাসার সামনের মুদি দোকানদার আমাকে প্রশ্ন করলো, আপনার সমস্যাটা কী? আমি জানতে চাইলাম কিসের সমস্যা? সে আবারো বললো, এটাতো পাগল। সেতো রাস্তাঘাটেই ঘুরে বেড়াবে। খামাখা পুলিশগুলোকে ডেকে কেন হয়রানি করালেন? আমি কী উত্তর দিবো খুঁজে পাচ্ছি না।
আমার সঙ্গে থাকা অ্যাপোলো হাসপাতালের সাহাদৎ ভাই তীব্র প্রতিবাদ করলেন। আমি শুধু বললাম, এরকম একটি কাজ একটিবার করে আপনি দেখিয়ে দেন না ভাই। কী আর করা! রাত সাড়ে বারোটা বাজে। অ্যাপোলো হাসপাতালের ওই ভাইটি তখনো আছেন আমার সঙ্গে। আমরা মেয়েটির কাছে আবারো গেলাম, বেশ বোঝালাম। কিন্তু সে আরো দুরে চলে গেল। আমার মন খারাপ হলো শুধু ওই দোকানদারের কথায়। এমন মানুষও আমাদের সমাজে আছে!! আর একটি বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো, এই ঢাকা শহরেই কতো মানুষ এসির মধ্যে ঘুমাচ্ছে, এই দেশে প্রায় ২০ কোটি লোকের ঠাঁই হয়েছে কিন্তু এই অসহায় ছোট্ট বোনটির জন্য একটু ঠাঁই নেই! রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা অন্য কেউ সেরকম ব্যবস্থাও রাখেনি!! আল্লাহ মেয়েটিকে হেফাজত করো।
ছবি তুলেছেন: সাহাদৎ হোসাইন
আতাউর রহমান কাবুল: সাংবাদিক