কী করে নিজেদের সেরা ভাবেন?
দেশের চিকিৎসা সেবা নিয়ে বলবেন, ডাক্তাররা গালি দেবে। অথচ দেশের সব সরকারি আর অনেক বেসরকারি হাসপাতালের পরিচালক, মালিকরা ডাক্তার। আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লিখবেন, তারা আপনাকে গালি দেবে। পুলিশের হয়রানি নিয়ে লিখবেন, পুলিশরা নাখোশ হবে। বালিশ তোলা নিয়ে বলবেন প্রকৌশলীরা আপনাকে টেন্ডারের নিয়ম শেখাবে। আদালত নিয়ে বলবেন, বিচারকরা ক্ষেপবে। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে কথা বলবেন, দেখবেন পন্ডিত সব শিক্ষকদের কটাক্ষ। রাষ্ট্রের কোনো অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে লিখবেন, শুনতে হবে আপনি দেশের উন্নয়ন চান না।
সংবাদ বা লেখালেখির প্রতিক্রিয়ায় গত ১৭ বছর ধরে আমাকে এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে সংকটটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই রাষ্ট্রে, এই দেশে কেউ এখন গঠনমূলক সমালোচনা নিতে পারে না। যেকোন ঘটনার পরপরই অদ্ভুত এক ব্যাখা দাঁড় করিয়ে ফেলে নিজ নিজ দপ্তরগুলো। তাদের কথা শুনলে মনে হবে, একেকটা দপ্তর ন্যায়ের প্রতীক। আর যিনি যেখানে আছেন সেটা বাদে বাকিরা খারাপ। একই মানুষকে দেখেছি তিনি যখন জনপ্রশাসনে তখন এক সুরে কথা বলছেন, স্বরাষ্ট্রে এসে আরেক সুর।
ওহে ভাইবোনেরা ভাই দেশটা কীভাবে চলছে সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসা করেন। তাদের কাছ থেকে শোনেন। ডাক্তার ছাড়া আর সবার কাছে ডাক্তার খারাপ, পুলিশ ছাড়া আর সবার কাছে পুলিশ খারাপ। আমলারা বলবে তারা ভালো। এসিল্যাণ্ড বলবে সাব রেজিস্ট্রার খারাপ। সাব রেজিস্ট্রার বলবে, তার তো কোনো ক্ষমতা নেই। সব দুর্ভোগ ভূমি অফিসে। এভাবেই তো চলছে সব। আর আমরা প্রত্যেকে যে যে পেশায় আছি তারা যেন সেই পেশার সব অনিয়ম দুর্নীতির ঠিকাদারি নিয়েছি। কেন রে ভাই? আপনি এই দেশে থাকেন না? এই দেশের হাসপাতাল, থানা, পুলিশ, আদালত, প্রশাসন, সড়ক, রেস্টুরেন্ট কোথায় গিয়ে কাঙ্খিত সেবা পান বলুন তো? তাহলে কীসের বড়াই করেন?
শত বছরের আমলাতন্ত্র কী করতে পেরেছে ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে? এখনো কেন সব সংকট জমিজমা নিয়ে? আপনারা এসিল্যাণ্ডরা এতোই করিৎকর্মা তা দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার এই হাল কেন? কী করছেন ৪৮ বছর ধরে? আচ্ছা পুলিশ ভাইয়েরা কেন এখনো মিথ্যা মামলায় মানুষ হয়রানির শিকার হয়? মাননীয় বিচারকেরা, বছবের পর বছর কেন আদালতে ঘুরতে হয় বিচার পেতে? ডাক্তার ভাইয়েরা আপনার স্বজনদের কোথায় চিকিৎসা করিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন? আমাদের পরিবহন, পানি, গ্যাস, সব সেবা কেমন? না জানলে জনগণকে জিজ্ঞাসা করুন।
আপনারা বলেন তো পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি যানজটের শহর, সবচেয়ে দূষিত শহর, দুর্নীতির শীর্ষ দেশগুলোর একটা, বসবাসের অযোগ্য শহরের মানুষ হয়ে কী করে এতো বুলি আওড়ান আপনারা? কী করে নিজেদের সেরা ভাবেন? আপনি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, বুকে হাত দিয়ে বলেন তো সেবার মান কেমন? বলেন তো ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলেও একজন ম্যাজিস্ট্রেটের যে মেরুদণ্ড ছিল আপনার আছে কী? কী বলবেন পুলিশ ভাইটি? ডাক্তার ভাইদের তো আবার কোনো কিছু বলাই যাবে না। আমি খুব অবাক হই, রাতারাতি একেকটা চাকুরি পেয়ে, একেকজন একেক দপ্তরে গিয়ে এমনভাবে সবকিছুর ঠিকাদারি নেন যে লজ্জা লাগে। আপনি আমলা, যান না চিকিৎসা সেবা নিতে সরকারি হাসপাতালে। বুঝবেন সেবার মান কেমন। ডাক্তার সাহেব যান না একবার থানায়। পুলিশ ভাইয়েরা যান না আদালতে? আর বাংলাদেশের গণমাধ্যম, সাংবাদিকতা বিশেষ করে স্থানীয় সাংবাদিকতার সমস্যা নিয়ে এতো লিখেছি ক্লান্ত লাগে আজকাল। একটা দেশের সাংবাদিকতা, বিচার বিভাগ সবই যদি নষ্ট হয় মানুষ যাবে কার কাছে?
ওদিকে রাজনীতিবিদ ভাইয়েরা উন্নয়নের বুলি অওড়াচ্ছেন। আচ্ছা দেশের তো উন্নয়ন অনেক হয়েছে, তা আপনার সন্তানরা সব বিদেশে পড়ে কেন? কেন বিদেশে বাড়ি বানিয়েছেন? ছাত্রলীগের নেতাদের দেখি দিব্যি অন্যদের গালি দেন। তা ভাই আপনাদের মধ্যে এতো কোন্দল কেন? কেন নিজেদের দলের মেয়েরাও আপনাদের হাতে রেহাই পান না? হ্যাঁ কথা হয়তো ঠিক, সবকিছুর জন্য দায়ী আমাদের নষ্ট রাজনীতি। কিন্তু আপনি আমি কী করেছি রাজনীতিটা শুদ্ধ করার জন্য? আমি জানি না বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, ডাক্তার, পুলিশ, বিচারক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী বা যেকোনো পেশার মানুষটা কীভাবে বড় গলায় কথা বলেন।
এই দেশের অবস্থা তো আমি আপনি সবাই জানি। তাহলে কোথা থেকে আসে আপনাদের এতো অহঙ্কার? এই দেশের কোন খাতের সেবার মান কেমন সবাই জানে। সারা পৃথিবী তো ঘোরেন, খারাপ লাগে না! জানি সব পেশায় ভালো মন্দ আছে। ভালোদের বলবো, সমস্যাগুলোর সমাধান করুন। অন্তত কথা বলুন। তবে একটা কথা না বললেই নয়। এতো সংকটের পরেও অহঙ্কার যদি কারোর করার কথা থাকে তাহলে তো করা উচিত সেই কৃষকের যে এতোকিছুর পরেও ধান ফলায়। করা উচিত পুষ্টিহীন সেই পোশাককর্মীর যে দেশটাকে টিকিয়ে রেখেছে। করা উচিত কোটি প্রবাসীর যারা বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। অথচ কী অদ্ধুত কৃষক, পোশাককর্মী বা প্রবাসী শ্রমিক কারোই মর্যাদা নেই এদেশে। আমার কিন্তু পরিস্থিতি দেখে খুব লজ্জা করে। তাই আমি রোজ তাদের সম্মান জানাই। চেষ্টা করি তাদের সেবা করার। কারণ আমার কাছে তারাই বাংলাদেশ। কাজেই স্যারেরা সবাই চলুন অহঙ্কার বাদ দিয়ে মানুষ হই।
লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট