ই’তিকাফ পালন ও রমজানের শেষ দশকে ইবাদতের গুরুত্ব

ওমর ফারুক আব্দুল্লাহ
 | প্রকাশিত : ২০ মে ২০১৯, ১৪:২৮

ই’তিকাফের পরিচয়:

ই’তিকাফ এর শাব্দিক অর্থ অবস্থান করা। কোন স্থানে অবস্থান নেয়া। শরিয়তের পরিভাষায় ই’তিকাফ হলো- মসজিদে অবস্থান করা। মহান আল্লাহ বলেন- তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে মসজিদে ই’তিকাফ অবস্থায় সংগত মিলিত (সহবাস) হয়ো না। রমজান মাসের শেষ দশদিন মসজিদে ইবাদাতের নিয়তে অবস্থান করাকে ই’তিকাফ বলে।

তিকাফের মেয়াদ:

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. রমজানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন। (বুখারী-মুসলিম)

হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে তার মৃত্যু পর্যন্ত এবং এরপরে তার স্ত্রীগণও অংশটুকু বাড়তি রয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)

অন্য এক হাদীসে এসেছে—

আমি (প্রথমে) এ রাতের সন্ধানে প্রথম দশে ই‘তিকাফ পালন করি। অতপর ই‘তিকাফ পালন করি মাঝের দশে। পরবর্তীতে ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হয় যে, এ রাত শেষ দশে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে (এ দশে) ই‘তিকাফ পালনে আগ্রহী, সে যেন তা পালন করে। লোকেরা তার সঙ্গে ই‘তিকাফ পালন করল। রাসূল বলেন, আমাকে তা এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, আমি সে ভোরে কাদা ও মাটিতে সেজদা দিচ্ছি। অতপর রাসূল একুশের রাতের ভোর যাপন করলেন, ফজর পর্যন্ত তিনি কিয়ামুল্লাইল করেছিলেন। তিনি ফজর আদায়ের জন্য দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। তখন আকাশ ছেপে বৃষ্টি নেমে এল এবং মসজিদে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ল। আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। ফজর সালাত শেষে যখন তিনি বের হলেন, তখন তার কপাল ও নাকের পাশে ছিল পানি ও কাদা। সেটি ছিল একুশের রাত। [মুসলিম ]

তিকাফের উপকারিতা :

ফেরেশতারা দুআকরতে থাকে:: বুখারিতে বর্ণিত রয়েছে যে, যে ব্যক্তি এক নামাজ থেকে আরেক নামাজ পর্যন্ত নামাজের স্থানে অপেক্ষা করতে থাকে তার জন্য ফেরেশতারা দুআ’ করতে থাকেন।

যেহেতু ই’তিকাফকারী মসজিদে অবস্থান করতে থাকে সেহেতু সহজেই তিনি এই বরকত পান।

বেশি ইবাদাতের সুযোগ:: মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে, আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রমজানের শেষ দশক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসূল সা. সারারাত জেগে থাকতেন এবং নিজ পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে জাগাতেন ও তিনি নিজেও ইবাদাতের জন্য জোর প্রস্তুতি নিতেন।

ই’তিকাফকারী সহজেই এই সুযোগ পেতে পারেন। এছাড়াও ই’তিকাফকারী বেশি বেশি ইবাদাত করার সুযোগ পান। তাওবা করার সুযোগ পান। তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়ার সুযোগ পান।

ক্বদরের ফজিলত পাওয়া:

ই’তিকাফকারীর সবচেয়ে বড় লাভ হচ্ছে, তিনি ক্বদরের সুযোগ পান। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের মধ্যম দশকে ইতিকাফ করতেন। এক বছর এরূপ ইতিকাফ করেন, যখন একুশের রাত এল, যে রাতের সকালে তিনি তার ইতিকাফ হতে বের হবেন, তিনি বললেনঃ যারা আমার সঙ্গে ইতিকাফ করেছে তারা যেন শেষ দশক ইতিকাফ করে। আমাকে স্বপ্নে এই রাত (লাইলাতুল কদর) দেখানো হয়েছিল। পরে আমাকে তা (সঠিক তারিখ) ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য আমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছি যে, ওই রাতের সকালে আমি কাদা-পানির মাঝে সিজদা করছি। তোমরা তা শেষ দশকে তালাশ কর এবং প্রত্যেক বেজোড় রাতে তালাশ কর। পরে এই রাতে আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষিত হল, মসজিদের ছাদ ছিল খেজুর পাতার ছাউনির। ফলে মসজিদে টপটপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। একুশের রাতের সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কপালে কাদা-পানির চিহ্ন আমার দু’চোখ দেখতে পায়।

অন্যান্য হাদীসে এসেছে, ক্বদর শেষ সাত দিনে (বুখারী) শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিতে তালাশ কর (বুখারী ও মুসলিম) ২৭ এর রাত্রিতে ক্বদর হয় (তিরমিজী) ২১ এর রাত্রিতে ক্বদরের আলামতের সঙ্গে মিলে গেছে। (বুখারী)

তিকাফের শর্তাবলি :

ই‘তিকাফের অনেকগুলো শর্ত রয়েছে। ই‘তিকাফের জন্য কেউ কেউ রোজার শর্ত করেছেন। ই‘তিকাফের জন্য মুসলমান হওয়া শর্ত। কেননা কাফেরের ইবাদত গ্রহণযোগ্য হয় না।

* ইতেকাফকারীকে বোধশক্তিসম্পন্ন হতে হবে, কেননা নির্বোধ ব্যক্তির কাজের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। আর উদ্দেশ্য ছাড়া কাজ শুদ্ধ হতে পারে না।

* ভালো-মন্দ পার্থক্য করার জ্ঞান থাকতে হবে, কেননা কমবয়সী, যে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না, তার নিয়তও শুদ্ধ হয় না।

* ই‘তিকাফের নিয়ত করতে হবে, কেননা মসজিদে অবস্থান হয়ত ই‘তিকাফের নিয়তে হবে অথবা অন্য কোনো নিয়তে। আর এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য করার জন্য নিয়তের প্রয়োজন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘প্রত্যেক কাজের নির্ভরতা নিয়তের উপর, যে যা নিয়ত করবে সে কেবল তাই পাবে’। [বুখারী]

* ই‘তিকাফ অবস্থায় মহিলাদের হায়েজ-নিফাস থেকে পবিত্র থাকা জরুরি, কেননা এ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করা হারাম, অবশ্য ইস্তেহাজা অবস্থায় ই‘তিকাফ করা বৈধ। আয়েশা রাদিয়াল্লাহ আনহা আনহা বলেন: ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তার স্ত্রীগণের মধ্য হতে কেউ একজন ই‘তিকাফ করেছিলেন ইস্তেহাজা অবস্থায়। তিনি লাল ও হলুদ রঙের স্রাব দেখতে পাচ্ছিলেন, আমরা কখনো তার নীচে পাত্র রেখে দিয়েছি নামাজের সময়’। [বুখারী ]

ইস্তেহাজাগ্রস্তদের সঙ্গে অন্যান্য ব্যধিগ্রস্তদেরকে মেলানো যায়, যেমন যার বহুমূত্র রোগ বিশিষ্ট ব্যক্তি আছে, তবে শর্ত হল মসজিদ যেন অপবিত্র না হয়।

* গোসল ফরজ হয় এমন ধরনের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হতে হবে। অপবিত্র লোক মসজিদে অবস্থান করা হারাম। যদিও কোনো কোনো আলেম ওজু করার শর্তে মসজিদে অবস্থান বৈধ বলেছেন। আর যদি অপবিত্রতা, যৌন স্পর্শ অথবা স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ফলে হয়, তবে সকলের মতে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর যদি স্বপ্নদোষের কারণে হয়, তা হলে কারোর মতে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হবে না। আর যদি হস্তমৈথুনের কারণে হয় তা হলে সঠিক মত অনুসারে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। তবে স্বপ্নদোষের কারণে ই’তিকাফ ভঙ্গ হবে না।

* তিকাফ মসজিদে হতে হবে:

এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত যে ই‘তিকাফ মসজিদে হতে হবে, তবে জামে মসজিদ হলে উত্তম কেননা এমতাবস্থায় জুমার নামাজের জন্য ই’তিকাফকারীকে মসজিদ থেকে বের হতে হবে না।

মসজিদ থেকে বের হওয়ার বিধান:

* ই’তিকাফকারী যদি বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হয় তাহলে তার ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।

* আর ই‘তিকাফের স্থান থেকে যদি মানবীয় প্রয়োজন মিটানোর জন্য বের হয় তাহলে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হবে না।

* মসজিদে থেকে পবিত্রতা অর্জন সম্ভব না হলে মসজিদ থেকে বের হওয়ার অনুমতি আছে।

* বাহক না থাকার কারণে ই’তিকাফকারীকে যদি পানাহারের প্রয়োজনে বাইরে যেতে হয় অথবা মসজিদে খাবার গ্রহণ করতে লজ্জা বোধ হয়, তবে এরূপ প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে।

* যে মসজিদে ই‘তিকাফে বসেছে সেখানে জুমার নামাজের ব্যবস্থা না থাকলে জুমার সালাত আদায়ের প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া ওয়াজিব। আর এজন্য আগে ভাগেই রওয়ানা হওয়া মুস্তাহাব।

* ওজরের কারণে ই’তিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারে। ছাফিয়্যা রাদিয়াল্লাহ আনহা থেকে বর্ণিত হাদীস এর প্রমাণ: ‘ছাফিয়্যা রাদিয়াল্লাহ আনহা আনহা রমজানের শেষ দশকে ই‘তিকাফস্থলে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে কতক্ষণ কথা বললেন, অতঃপর যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে বিদায় দিতে উঠে দাঁড়ালেন’। [বুখারী : ২০৩৫]

* কোন নেকির কাজ করার জন্য ই’তিকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়। যেমন রোগী দেখতে যাওয়া, জানাযায় উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি। এ মর্মে আয়েশা রাদিয়াল্লাহ আনহা আনহা বলেন: ‘ইতেকাফকারীর জন্য সুন্নত হল, সে রোগী দেখতে যাবে না, জানাযায় উপস্থিত হবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না ও তার সঙ্গে কামাচার থেকে বিরত থাকবে এবং অতি প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হবে না’। [আবূ দাউদ : ২৪৭৩]

* ই‘তিকাফ-বিরুদ্ধ কোন কাজের জন্য ই’তিকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়, যেমন ক্রয়-বিক্রয়, স্বামী-স্ত্রীর মিলন ইত্যাদি।

অতএব, শেষ দশকে ই’তিকাফ করার প্রতি অনেক গুরুত্ব রয়েছে। রাসূল সা. তার জীবনে ই’তিকাফ ছাড়েন নি। আমরা যারা ই’তিকাফ করতে পারব না, তারা অন্তত শেষ দশকে ইবাদতের প্রতি একটি বিশেষ গুরুত্ব দিব! মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে বেশি বেশি ইবাদত করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: লোকমান হাকিম দাখিল মাদ্রাসা, ঢাকা।

ঢাকা টাইমস/২০মে/একে

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :