এনবিএলের শেয়ার কেনার সিদ্ধান্তে ‘বড় প্রশ্ন’

রহমান আজিজ
| আপডেট : ২১ মে ২০১৯, ০৯:১৯ | প্রকাশিত : ২১ মে ২০১৯, ০৯:১৫

মাস আটেক আগে ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের বড় অংকের শেয়ার কিনে লোকসানে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড-এনবিএল। এই শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে আছে বড় ধরনের প্রশ্ন। কারণ, এনবিএল যে পরিমাণ শেয়ার কিনেছে, ন্যাশনাল হাউজিং-এর এক পর্ষদ সদস্যের প্রায় সমপরিমাণ শেয়ার বিক্রি করেছেন। এই দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে বলে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আর এই শেয়ার কেনাবেচা শেষেই পড়ে যায় শেয়ারের দাম।

কিন্তু না নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি, না ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ডিএসই বিষয়টি খতিয়ে দেখেনি। এখন এনবিএল অন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের বড় পরিমাণে শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা ঢাকা ব্যাংকের পাঁচ শতাংশ শেয়ার কিনতে যাচ্ছে, যা সংখ্যা চার কোটি ১০ লাখেরও বেশি।

এনবিএল যখন ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্সের শেয়ার কেনার ঘোষণা দেয়, তার আগে আগের এক মাস শেয়ারটির দাম হঠাৎ লাফ দেয়। ৩৯ টাকা থেকে লাফ দিয়ে ৬৫ টাকা হয়ে যাওয়ার পর এনবিএলের এই ঘোষণা আসে।

ওই ৩০ লাখ শেয়ার কিনে সাড়ে ছয় থেকে সোয়া আট কোটি টাকা লোকসানে আছে এনবিএল। ব্যাংকটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই লোকসানকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে ঢাকা ব্যাংকের শেয়ার থেকে মুনাফার আশা করেছেন।

২০১৮ সালের ২৭ আগস্ট ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স ডিএসইকে জানায়, এনবিএল তাদের ৩০ লাখ দুই হাজার ১৬০টি শেয়ার কিনবে। এই বিপুল পরিমাণ কেনার ঘোষণার পর পরই ন্যাশনাল হাউজিংয়ের শেয়ার এর দর বেড়ে যায় এবং প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তাদের অপ্রকাশিত কোনো সংবেদনশীল তথ্য নেই।

১০ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল হাউজিংয়ের পর্ষদ সদস্য সৈয়দ আলী জওহার রিজভী তার হাতে থাকা ২৮ লাখ ৮৪ হাজার ৮৬০টি শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন। ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি জানান, সব শেয়ার বিক্রি হয়ে গেছে। আর দুই দিন পর এনবিএল জানায়, তারা তাদের ঘোষণা অনুযায়ী ৩০ লাখের কিছু বেশি শেয়ার কিনে নিয়েছে।

এনবিএল মোট কত টাকায় এই শেয়ার কিনেছে, সেটা তারা জানায়নি। তবে তারা যেদিন ক্রয়ের ঘোষণা দেয়, সেদিন শেয়ারটির দাম ছিল ৬৫.৮০ টাকা। এক পর্যায়ে ৪ সেপ্টেম্বর এই শেয়ারটির দাম ৮২.১০ টাকায় গিয়ে ক্লোজ হয়। সর্বোচ্চ উঠে ৮৫.৯০ টাকা। আর যেদিন এনবিএল তার শেয়ার কেনা শেষের ঘোষণা দেয়, সেদিন এর ক্লোজ প্রাইস ছিল ৬০.৬০ টাকা। আর দুই দিন আগে আলী জওহার যেদিন শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন, সেদিন ক্লোজ প্রাইস ছিল ৬১.৫০ টাকা।

এই প্রতিষ্ঠানটি গত ডিসেম্বরে শেষ হওয়া অর্থবছরের জন্য ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ও শেয়ারপ্রতি এক টাকা মুনাফা দিয়েছে। অর্থাৎ এনবিএলের গড় ক্রয়মূল্য ৭০ টাকা হলে এটি এখন ৬২ টাকা। আর ৬৫ টাকা হলেও ৫৮ টাকা পড়েছে। গতকাল শেয়ারটির ক্লোজ প্রাইস ছিল ৩৯ টাকা ৭০ পয়সা। যদি শেয়ারপ্রতি তাদের গড় ক্রয়মূল্য ৬৫ টাকা হয় তাহলেও এই মুহূর্তে ছয় কোটি ৬০ লাখ ১৭ হাজার টাকার মতো লোকসানে আছে এনবিএল। আর তাদের গড় ক্রয়মূল্য ৭০ টাকা হলে এই লোকসান দাঁড়ায় সাত কোটি ৯৫ লাখ টাকার মতো।

ন্যাশনাল হাউজিংয়ের শেয়ার কেনার রেশ কাটতে না কাটতে এনবিএল এবার আরও বড় পরিমাণে শেয়ার কিনতে যাচ্ছে। তারা ঢাকা ব্যাংকের চার কোটি ৬ লাখ ২৯ হাজার ১৩৪টি শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকালের বাজার মূলে এই পরিমাণ শেয়ার কিনতে হলে ৬০ কোটি টাকার বেশি খরচ হবে। এই খবরটি এখনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে ডিএসইর ওয়েবসাইটে আসেনি। তবে একটি গণমাধ্যমে খবরটি আসার পর ঢাকা ব্যাংকের শেয়ার দর বেড়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম বুলবুল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘লাভ-ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েইে অর্থনৈতিক কর্মকা- করে ব্যাংক। আমরা লাভের আশায় ২০১৮ সালে ন্যাশনাল হাউজিংয়ের শেয়ার কিনেছি। কিন্তু পুঁজিবাজারের দরপতনের কারণে আমরা লোকসান খেয়েছি। এটি ওই বছরই লোকসান দেখিয়েছি।’

‘নতুন করে আমরা ঢাকা ব্যাংক কেনার ঘোষণা দিয়েছি। তাদের আর্থিক সূচক দেখেই মূলত কেনার ঘোষণা দিয়েছি। আশা করি, আমরা লাভবান হব।’

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক মুজিব উদ্দিন আহমেদ অবশ্য মনে করেন এনবিএলের ন্যাশনাল হাউজিংয়ের শেয়ার কেনার ওই সিদ্ধান্তের পেছনে কিছু একটা ছিল। তিনি বলেন, ‘বহু বছর ধরে ন্যাশনাল ব্যাংক এটি করছে। ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত তারা অনেক কিছুই করেছে। ব্যাংকের শেয়ার কেনার ঘটনা দৈনন্দিন ঘটনা। আর্থিক সুবিধার কোনো ঘটনা আছে কি না সেটা তো আপনি আমি বলতে পারি না। সেটা তো দুই প্রতিষ্ঠানের ইন্টারনাল ব্যাপার। তবে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিত।’

তবে ঢাকা ব্যাংকের বড় অংকের শেয়ার কিনতে হবে বলে এনবিএলকে এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। দুই ব্যাংকের পর্ষদে পাস হওয়ার পর শেয়ার কেনাবেচার বিষয়টি অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানোও হয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরেই সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণও করতে পারছে না ব্যাংকটি। এজন্য অনেক বছর ধরেই বোনাস শেয়ার ইস্যু করতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হচ্ছে অভিহিত মূল্য ১০ টাকারও নিচে।

মূলত শেয়ার কেনার মাধ্যমে ঢাকা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আসতে চাচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। ন্যাশনাল ব্যাংকের একক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে জয়নুল হক সিকদার ও তার পরিবারের।

দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে ১৯৯৫ সালের ৫ জুলাই যাত্রা করে ঢাকা ব্যাংক। ২০০০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ব্যাংকটি। বর্তমানে ব্যাংকটির শেয়ার সংখ্যা ৮১ কোটি ২৫ লাখ ৮২ হাজার ৬৮৫টি। গত ডিসেম্বরে শেষ হওয়া অর্থবছরে ব্যাংকটি পাঁচ শতাংশ করে বোনাস ও নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই হিসাবে ঢাকা ব্যাংকের শেয়ার সংখ্যা পাঁচ কোটির মতো বাড়বে।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৪৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছে ঢাকা ব্যাংক। ২০১৮ সালে ১৪০ কোটি টাকা নিট মুনাফা পায় ঢাকা ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ন্যাশনাল ব্যাংক ঢাকা ব্যাংকের শেয়ার কেনার ব্যাপারে আইনগত বাধা দেয়ার ক্ষমতা কারোর নেই। এটা কেনার ফলে কার লোকসান হবে আর কার লাভ হবে সেটা ব্যাংক দুটির ব্যাপার।’

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে এনবিএলের শেয়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২৬৫ কোটি ৪৯ লাখ, সাত হাজার ৯১৩টি শেয়ার থাকা ব্যাংকটি চলতি বছর আরো ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধসের পর থেকে এনবিএল বেকায়দায় আছে। ওই বছর তাদের শেয়ার মূল্য ২০০ টাকা ছাড়ালেও এখন অভিহিত মূল্য ১০ টাকারও নিচে।

বড় অংকের খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকটি। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল দুই হাজার ৭০২ কোটি টাকার। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করতে পেরেছে এক হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে ন্যাশনাল ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ এক হাজার ২৭৮ কোটি টাকা।

সঞ্চিতি সংরক্ষণ না করে প্রতি বছরই মুনাফা দেখাচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ২০১৮ সালেও ৩৮৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা দেখিয়েছে ব্যাংকটি। যদিও তা আগের দুই বছরের তুলনায় অনেক কম। ২০১৬ সালে ব্যাংকটি ৫৬০ কোটি এবং ২০১৭ সালে প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ‘ন্যাশনাল ব্যাংকে যেহেতু জনগণের অর্থ আছে সেটি বিবেচনা করে তাদের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। সে বিষয়টি ভেবেই নতুন করে তারা ঢাকা ব্যাংকের শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা সম্পূর্ণ তাদের পর্ষদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংককে বুঝেশুনে অনুমোদন দেওয়া উচিত।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :