লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতি মোকাবেলায় কৌশল নির্ধারণে ব্যর্থ বিরোধীরা

প্রকাশ | ২৪ মে ২০১৯, ১০:১০ | আপডেট: ২৪ মে ২০১৯, ১৩:৫৩

আলী রীয়াজ

ভারতের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপির বিজয়ের একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদ বা পপুলিস্ট অথরিটারিয়ানিজমের যে রাজনীতি তা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে বিরোধীরা রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা কেবল নির্বাচনের কৌশলের প্রশ্ন নয়, এটা হচ্ছে যেকোনো দেশে রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতিতে যে পরিবর্তন ঘটেছে এবং ঘটছে তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়ার লক্ষণ। এটা রাজনৈতিক কৌশলের প্রশ্ন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দেশে লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদ বিরোধীরা গত দশকের বা তারও আগের রাজনীতির অভিজ্ঞতা দিয়েই এই নতুন রাজনীতি মোকাবেলা করতে চেষ্টা করেন এবং ভারতেও তাই হয়েছে। ফলে তাঁদের রাজনীতির কৌশল এখন আর নতুন বলে বিবেচিত হয় না। বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজি, বিকাশমান নতুন মধ্যবিত্ত এবং রাজনৈতিক দলের যে মেলবন্ধন ঘটেছে ভারতে তার প্রতিনিধিত্ব করে বিজেপি এবং এর পারসোনিফিকেশন হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি।

অন্য বেশ কিছু দেশেও এই ধরণের দল এবং ব্যক্তিরাই এখন ক্ষমতায়। এই রাজনীতির মোবালিজেশনের মন্ত্র হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা– এগুলো একদিকে সাধারণ মানুষকে দলে টানার উপায় এবং বিভক্তি তৈরির উপাদান। এগুলো অসহিষ্ণুতা তৈরি করে। যাকে পুঁজি করেই বিভক্তির রাজনীতির বিকাশ ঘটে এবং সেখানে পুরনো কৌশলগুলো কার্যকর থাকে না। বিরোধীদের রাজনীতি রিএ্যাকটিভ, প্রোএ্যাকটিভ নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের’ এক ধরণের বাগাড়ম্বর। এই পপুলিস্ট অথরিটারিয়ানিজমের বাহকেরা অর্থনৈতিক চাকচিক্য তৈরি করে, কিন্ত সাধারণ মানুষের ভাগ্যন্নোয়নের প্রতিশ্রুতি তাঁরা পালন করেন না। মোদি তার ব্যতিক্রম নয়।

মোদি গত নির্বাচনে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালন করেননি। কিন্ত তারপরেও যে এই ধরণের দল এবং নেতারা ক্ষমতায় টিকে থাকেন, পুনঃনির্বাচিত হন তার কারণ হচ্ছে তারা নিজেদের নতুন রাজনীতির ধারক হিসেবে হাজির করেন।

ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারকেই যে কেবল তা বোঝানো গেছে তা নয়, প্রতিষ্ঠিত দলগুলো একইভাবে বিভ্রান্ত হয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে ভারত যে কেবল আঞ্চলিক শক্তি বা বিশ্ব-শক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষী হিসেবে সামরিকভাবেই নিজেকে প্রস্তত করছে তা নয়, একইসঙ্গে এক ধরণের নন-ইনক্লুসিভ কাঠামোও তৈরি করেছে। সেখানে মুসলিম বা দলিতরা যে কেবল বাদ পড়ছেন তা নয়, কাশ্মিরিরাই যে কেবল নিপীড়িত হচ্ছেন তা নয়-এর নিয়ন্ত্রণের কাঠামোও সীমিত হয়েছে এক বা কয়েকটি গোষ্ঠির হাতে।

এই রাষ্ট্রের চরিত্র হচ্ছে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করা,  মত প্রকাশের অধিকার সীমিত করা, স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপরে খড়গ চালানো, যুক্তনিষ্ঠ আলোচনাকে আক্রমণ করা, বিজ্ঞানের বদলে ‘বিশ্বাসকে (ফেইথ) প্রাধান্য দেয়া। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ বা মেজরিটারিইনিজম হচ্ছে এর ভিত্তি। তাঁরা উগ্র জাতীয়াবাদের জিগির তুলেছেন।  এই জাতীয়তাবাদের জিকির কতটা আবেদন সৃষ্টি করতে পারে তা বুঝতে চাইলে সাম্প্রতিককালে বালাকোটের ঘটনায় ভারতের অধিকাংশ গণমাধ্যমের ভূমিকা থেকেই স্পষ্ট।

তারা ‘হিন্দু’পরিচয়কে একটি হাতিয়ারে পরিণত করেছেন। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা তাদের লক্ষ্য। এগুলো আমার (এবং সম্ভবত আপনার) কাছেও অগ্রহণযোগ্য কিন্ত প্রচারের জৌলুষপূর্ণ মোড়কে তা তার সাধারণের কাছে একটা ‘প্রডাক্ট’ হিসেবে বিক্রি করতে সক্ষম হচ্ছেন। এর বিপরীতে রাজনীতি কেমন হবে? সেই প্রশ্নের উত্তর ভারতের কংগ্রেস বা অন্যরা দিতে পারছেন না। (এই ধরণের ব্যর্থতা কংগ্রেসের একার নয়, সেটাও আমদের ভুললে চলবে না)। কেননা তারা এখনও ভারতের রাজনীতিকে ভাবছেন সেক্যুলারিজম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির লড়াই। একথা বলার অর্থ এই নয় যে, আমি বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভেতরে ধর্মের উপাদানকে অস্বীকার করছি। আগেও বলেছি যে ধর্ম তাদের একটি মন্ত্র। কিন্ত আদর্শের যেই জায়গায় পার্থক্য তৈরি করা দরকার তা হচ্ছে কর্তৃত্ববাদ এবং পপুলিজম (লোকরঞ্জনবাদ) এর বিপরীতে রাজনৈতিক দলগুলো কী দিতে পারে।

ভারতের সমাজের ভেতরেও পরিবর্তন ঘটেছে। সেই পরিবর্তনের মধ্যে ধর্মাশ্রয়ীতা একটি দিক। রক্ষণশীলতা এবং এ্যান্টি-ইন্টেলেকচুয়ালিজম আমরা দেখতে পাই। ভারত কি অপরিবর্তনীয়ভাবে, অর্থাৎ ইররিভারসেবলি বদলে গেছে? তাকে কীভাবে মোকাবেলা করা হবে তার কোনো উত্তর নেই। পপুলিজমের মোকাবেলার কার্যকর আদর্শ কোনটি? আরেক ধরণের পপুলিজম? কৌশল কী হবে? রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্যের কোনটি মৌলিক, সেটি কতটা বিচার্য এবং আশু ও গভীর বিপদের চেয়ে অতীত ইতিহাস কতটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার উত্তর চাইলেই পাওয়া যায়। কিন্ত ভারতের কংগ্রেস এবং আঞ্চলিক দলগুলো তা ভেবে দেখেছেন বলে মনে হয় না।

পপুলিস্ট অথরিটারিয়ানিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য যে ব্যাপক শক্তি সমাবেশ ঘটানো দরকার তার অন্যথা কেবল ভারতেই দৃশ্যমান তা নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের এই পরিবর্তনের কারণে রাজনীতির যে পরিবর্তনের তাগিদ তৈরি হয়েছে তা উপলব্ধি করতে না পারলে কি হয় ভারতের নির্বাচন তার প্রমাণ, সেটাই শিক্ষনীয় বিষয়। 

লেখক: অধ্যাপক আলী রীয়াজ

সরকার ও রাজনীতি বিভাগ

ইলিনয় স্টেট ইউনভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র